ছোটগল্প সমাচার

সূচনাকাল থেকেই জীবনের বহুমাত্রিক দিক উন্মোচন করে চলেছে বাংলা ছোটগল্প। বাংলা সাহিত্যের এই ধারায় বিস্তৃত পরিসর ও পটভূমি নিয়ে মানবজীবনের নানা অনুষঙ্গ প্রতিফলিত হয়েছে। একসময় ফ্রয়েডীয় ও মার্কসবাদী চেতনা ছোটগল্পের ভুবনকে সমৃদ্ধ করেছিল। অন্যদিকে প্রান্তিক ও ব্রাত্য মানুষের জীবনসংগ্রাম ছোটগল্পকে নানাদিক থেকে করে তুলেছিল জিজ্ঞাসা-উন্মুখ।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচিত ছোটগল্পে মননধর্মিতার সঙ্গে সাধারণ লোকজীবন-উপলব্ধিকে যে প্রসারিত চেতনায় বিস্তৃত করেছিলেন, তা বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে অনন্য অধ্যায় হয়ে আছে। তাঁর হাতেই বাংলা ছোটগল্প সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। তিনি বাংলা ছোটগল্পে প্রকরণ ও শৈলী নির্মাণেরও প্রধান পুরুষ। তাঁর মতো করে জীবনের বহু দিক তাঁর সমসাময়িকদের আর কেউ প্রতিফলিত করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ সাহিত্য পাঠকদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় গ্রন্থ। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের চেতনাধারায় স্নাত হয়ে গল্পের ভুবন আরো সমৃদ্ধ ও বিচিত্র বৈভবে ঋদ্ধ হয়ে উঠেছিল। এই সময়ে মার্কসবাদী কয়েকজন গল্পকার এমনসব গল্প লিখেছিলেন যা ছিল জীবনচেতনার দিক থেকে অতল এবং নবীন জিজ্ঞাসার বিচ্ছুরণে দীপ্ত।

গত শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে বাংলাদেশের ছোটগল্প নানাভাবে সমৃদ্ধ হতে থাকে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলাদেশে যেসব ছোটগল্প রচিত হয়েছিল তা ছিল জীবনের উত্তাপলগ্ন। এসব গল্পের মধ্যে গ্রামীণ ও নাগরিক মানুষের বৃহত্তর জীবনসংগ্রাম ও বেঁচে থাকার আর্তি প্রতিফলিত হয়েছিল। প্রেম, আকাক্সক্ষা ও স্বপ্ন নানা দৃষ্টিকোণ থেকে উঠে এসেছিল। সামরিক শাসন, প্রথার কর্তৃত্ব এবং বৈরী রাজনৈতিক বাস্তবতা কথাসাহিত্যের সৃজনধারাকে ব্যাহত করতে পারেনি। এ-অঞ্চলের নদী, মাটি ও মানুষের সঙ্গে ছোটগল্পকারদের নিবিড় সংযোগের ফলে এবং বোধ ও বুদ্ধির প্রয়োগে ছোটগল্প তার বৈশিষ্ট্য নিয়ে নানাভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।

ষাটের দশকে এই অঞ্চলের বাঙালির সংগ্রামী চেতনা ও বাঙালিত্বের সাধনা যখন স্বদেশনির্মাণের আকাক্সক্ষায় উদ্বেল, তখন থেকে ছোটগল্পের স্বরূপও পাল্টাতে থাকে। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও জীবনের নানা সূক্ষ্ম সংবেদনশীল জিজ্ঞাসার উন্মোচন পাঠকের অভিজ্ঞতার দিগন্তকে বিস্তৃত করে। মনন ও শিল্পের দিক থেকে নতুন বেগ সঞ্চারিত হয় ছোটগল্পে। জীবন-অভিজ্ঞতার মনোগ্রাহী দলিল হয়ে ওঠে সাহিত্যের এই ধারা।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাংলাদেশের ছোটগল্পকারদের মানসভুবনকে নানা দিক থেকে সমৃদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ছোটগল্প রচিত হয়।

বাংলাদেশের ছোটগল্পের ভুবনে বর্তমানে নবীন বেশ কয়েকজন শক্তিশালী গল্পকারের আবির্ভাব আমাদের আশান্বিত করে। সমকালীন জীবনচেতনা ও সংগ্রাম প্রতিফলিত হচ্ছে তাঁদের সৃষ্টিতে।

বাংলাদেশের ছোটগল্পের চর্চা ও সম্ভাবনাকে ধরে রাখতে চেয়েছি। আমরা চেষ্টা করেছি সংখ্যাটিকে সমৃদ্ধ করতে। বিশেষ গুরুত্ব ও প্রাধান্য দিয়েছি নবীন ছোটগল্পকারদের রচনার প্রতি। তাঁদের মধ্যে যে-প্রাণশক্তি, বিশ্বস্ত জীবনচেতনা, সমাজ-অঙ্গীকার ও প্রতিকূলতাকে অতিক্রমণের ঐকান্তিক প্রয়াস আমরা প্রত্যক্ষ করছি তা আমাদের গল্পের ভুবনকে সমৃদ্ধ করবে – এ-প্রত্যয়ে আমরা নিশ্চিত। এই সংখ্যাটি চতুর্থ-পঞ্চম যুগ্ম সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *