গোলাম মোরশেদ খান
আমরা এমন এক দৃশ্যমান বস্তুজগতের বাসিন্দা, যার পাশাপাশি রয়েছে অদৃশ্য অণুজীবের এক সমান্তরাল জগৎ (চধৎধষষবষ ড়িৎষফ)। জীবজগতের মোট ২৩টি বিভাগের ভেতর মাত্র তিনটিকে আমরা খালি চোখে দেখতে পাই – প্রাণী, বৃক্ষ ও ছত্রাক। বাকি সবাই আমাদের চোখের অন্তরালে, যা মোট জীবজগতের প্রায় ৮০ শতাংশ। এই অণুজগৎ আমাদের এমনভাবে বেষ্টন করে আছে যে তা আমাদের দেহের ভেতরে ও বাইরে সমানভাবে বিরাজমান। আমাদের ত্বকের প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে রয়েছে অন্ততপক্ষে এক লাখ জীবাণুর উপস্থিতি, যারা আমাদের ত্বকের মৃত কোষকলা এবং লোমকূপ থেকে নিঃসৃত রস খেয়ে বেঁচে থাকে। এভাবেই বিলিয়ন বিলিয়ন জীবাণু আমাদের নাক, মুখ, চোখ, কান ও অন্যান্য রন্ধ্রপথে, যা বহির্জগতের সঙ্গে আমাদের দেহাভ্যন্তরকে যুক্ত করে রেখেছে – সেগুলোতে নিঃসংকোচে বাস করছে। সত্যিকার অর্থে, এদের উপস্থিতি ছাড়া আমরা বাঁচতেই পারব না, কারণ এরা আমাদের খাদ্য পরিপাক থেকে অনেক ধরনের কাজেই নিত্যসঙ্গী। আমাদের পরিপাকতন্ত্রে রয়েছে অন্তত ৪০০ ধরনের শত ট্রিলিয়ন অণুজীবের উপস্থিতি। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরে প্রায় ১০ কোয়াড্রিলিয়ন জীবকোষ (পবষষ) থাকে, কিন্তু তার শরীরে মোট অণুজীবের সংখ্যা এরও প্রায় দশগুণ। আমরা নানা উপায়ে তাদের ধ্বংস করার ফন্দি করলেও এ-পৃথিবীতে তারা কোটি কোটি বছর ধরে বেঁচে আছে এবং থাকবে, বলতে গেলে এটা তাদেরই পৃথিবী এবং তারা অনুমতি দিচ্ছে বলেই তাদের অনুগ্রহে আমরা এ-পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারছি।
প্রখ্যাত মার্কিন জীববিজ্ঞানী লিন মারগুইলিস যেমনটা বলেছেন, পৃথিবীতে আমাদের উপস্থিতি ছাড়াও জৈবজগৎ ভালোভাবে বেঁচে থাকবে; কিন্তু অণুজীব না থাকলে মাত্র কয়েক সপ্তাহেই পৃথিবীপৃষ্ঠ চন্দ্রপৃষ্ঠের মতো উষর, প্রাণহীন হয়ে পড়বে।
বেশিরভাগ অণুজীবই হয় আমাদের জন্য উপকারী, নয় নিরপেক্ষ – মাত্র হাজারে একটি অণুজীব আমাদের জন্য ক্ষতিকর। যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজে অণুজীব আমাদের সহায়তা করছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে – মাটিকে উর্বর ও ফলদায়িনী করা, জলকে বিশুদ্ধ রাখা, আমাদের অন্ত্রে ভিটামিন প্রস্তুত করা ও খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করা, নাইট্রোজেন চক্রকে সহায়তা করে আমিষ জাতীয় জিনিস (Amino acids nucleotides) উৎপন্ন করা ইত্যাদি। তারা যদি নাইট্রোজেন উৎপাদনে সহায়তা না করত, তাহলে শুধু আমরা কেন, কোনো বৃহৎ প্রাণীই বেঁচে থাকতে পারত না। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন তৈরিতেও তাদের ভূমিকা রয়েছে। তাদের বেঁচে থাকার প্রাণশক্তিও অফুরান। নোবেলজয়ী বেলজিয়ান জৈব রসায়নবিদ ক্রিস্টিয়ান ডি জ্যুব বলেছেন, প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা হলে একটিমাত্র জীবাণু মাত্র একদিনে তার দুই লাখ আশি হাজার বিলিয়ন কপি তৈরি করতে সক্ষম। আর এই বংশ বিস্তারকালে প্রতি মিলিয়ন কপিতে একবার একটি নতুন ধরনের মিউট্যান্ট জিন তৈরি হয়, যা নতুন একটি জিন কোড লাভ করে। খাদ্য হিসেবে তারা খেতে সক্ষম কাগজ, ওয়ালপেপার, কাঠ, পাথর, এমনকি ধাতু পর্যন্ত।
অস্ট্রেলিয়ান জীববিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন এমন একটি জীবাণু, যা ধাতু গলাতে সক্ষম শক্তিশালী সালফিউরিক অ্যাসিডেও বেঁচে থাকতে পারে। আবার এমন ধরনের জীবাণু পাওয়া গেছে, যারা পারমাণবিক রিঅ্যাক্টরের বর্জ্য-সংগ্রাহকের মধ্যেও বেঁচে থাকতে সমর্থ। তাদের জীবিত পাওয়া গেছে কস্টিক সোডার হ্রদে, উষ্ণ প্রস্রবণের ফুটন্ত পানিতে, অ্যান্টার্কটিকার হিমশীতল পানিতে, প্রশান্ত মহাসাগরের এগারো কিলোমিটার নিচে, যেখানে পানির চাপ পৃথিবীপৃষ্ঠে বায়ুচাপের চেয়ে হাজারগুণ বেশি। একটি সিল করা ক্যামেরা, চন্দ্রপৃষ্ঠে যা দু-বছর কাজ করেছে, তা পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার পর তা থেকেও জীবিত স্ট্রেপটোকক্কাস জীবাণু আবিষ্কার করা গেছে। প্রতিকূল পরিবেশে জীবাণুরা নিজেদের গুটিয়ে নেয় এবং সুদিনের অপেক্ষায় থাকে নবজন্ম লাভের জন্য, যা তাদের দীর্ঘজীবন লাভের রহস্য।
নরওয়ের একদল বিজ্ঞানী ১৯৯৭ সালে আশি বছর ধরে সুপ্ত থাকা অ্যানথ্রাক্স জীবাণুর স্পোরকে আবার পুনর্জীবিত করতে সমর্থ হয়েছেন। একইভাবে পাওয়া গেছে ১১৮ বছরের পুরনো মাংসের টিন থেকে এবং ১৬৬ বছরের পুরনো বিয়ার থেকে উদ্ধার করা নবজীবনপ্রাপ্ত জীবাণু। তবে এ-বিষয়ে রেকর্ড হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার ওয়েস্ট চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসেল ভিরল্যান্ড ও তাঁর সহযোগীদের, যাঁরা ২০০০ সালে ২৫০ মিলিয়ন বছর বয়সী সুপ্ত জীবাণুকে নতুন জীবন দিতে সমর্থ হয়েছেন, যা নিউ মেক্সিকোর লবণখনিতে মাটির ৬০০ মিটার গভীরে আটকে ছিল। সম্ভবত সে-জীবাণু মহাদেশটির চেয়েও পুরনো।
১৯৫২ সালে জীবাণু-প্রতিরোধক পেনিসিলিন যখন কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে, তখন মার্কিন সার্জন জেনারেল উইলিয়াম স্টুয়ার্ট খুব নিশ্চিত ভাব নিয়ে ঘোষণা করেন, ‘সংক্রমক রোগের খাতাটি বন্ধ করার সময় পৃথিবীতে এসে গেছে। অন্তত আমেরিকা থেকে সংক্রমণকে আমরা দূর করতে পেরেছি।’ কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি – পেনিসিলিন ও তৎপরবর্তী আরো কিছু দামি জীবাণু-প্রতিরোধক জীবাণুঘটিত রোগের সংক্রমণকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সমর্থ হলেও অণুজগতের অন্য একটি জীব (?) ভাইরাস আমাদের এখনো বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে চলেছে। এই ভাইরাস হচ্ছে অণুজীব জগতের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম একক, যা পরগাছার মতো কোনো জীবকোষ থেকে শক্তি সংগ্রহ না করে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে পারে না। এই ভাইরাস এমনকি জীবাণুকেও আক্রমণ করতে পারে। ভাইরাস হচ্ছে, জীবিত ও নিষ্প্রাণ বস্তুর মাঝামাঝি একটি জিনিস। নোবেলজয়ী জীববিজ্ঞানী পিটার মেভাওয়ারের ভাষায় যা হচ্ছে, ‘নিউক্লিক অ্যাসিডের একটি সুতা, যা চারদিকে দুঃসংবাদ দিয়ে আবৃত।’