প্রসঙ্গকথা ও সাক্ষাৎকার গ্রহণ : মতিন রায়হান
প্রসঙ্গকথা
কলিম শরাফী। জন্ম ৮ মে ১৯২৪। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার খয়রাডিহি গ্রামে। ভারত উপমহাদেশের জাতীয় আন্দোলনসহ নানা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব তিনি। নিবেদিতপ্রাণ এই রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী যখন দশম শ্রেণির ছাত্র তখন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ডাকে ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’ অপসারণের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষাশেষে ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধীর ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে যোগ দিয়ে প্রথম কারাবরণ করেন। সিউড়ি জেলে পরিচয় ঘটে বিখ্যাত সব কংগ্রেস নেতার সঙ্গে। এগারো মাস জেলে থাকাকালে প্রণব গুহঠাকুরতার কল্যাণে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে শুরু করেন। জেলে তাঁদের ‘স্বদেশি বাবু’ বলে সম্বোধন করা হতো। কলিম শরাফী ছিলেন একমাত্র মুসলিম ‘স্বদেশি বাবু’। রাজনীতি সংশ্লিষ্টতার কারণে ভর্তি হতে পারলেন না শান্তিনিকেতনে। দেশজুড়ে পঞ্চাশের মন্বন্তর শুরু হলে কলিম শরাফীরা দলবেঁধে গাইতে শুরু করেন নবজীবনের গান। অংশ নেন লঙ্গরখানার খাবার বিতরণেও। রাতদিন খাটাখাটুনিতে এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাওয়াবদলের জন্যে যান দার্জিলিংয়ের কালিম্পংয়ে। সেখানে পরিচয় ঘটে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে। ১৯৪৫ সালে সেখানে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। কেবল অর্থনৈতিক কারণেই মেডিক্যালের পড়া ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। এ-খবর পেয়ে ‘কাকাবাবু’মানে মুজফ্ফর আহমদ খুব কষ্ট পান। ১৯৪৩ সালেই যোগ দিয়েছিলেন ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনে (আইপিটিএ) অর্থাৎ গণনাট্য সংঘে। ১৯৪৬ সালে ভর্তি হয়েছিলেন কৃষ্ণনাথ কলেজে। সে-বছরই দাঙ্গা শুরু হলে তিনি ‘বর্ডার গার্ডে’র দায়িত্ব পালন করেন। তখন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্যে মহল্লায় মহল্লায় কাজ করে বেড়ান। এইচএমভি থেকে একই বছরই বের হয় তাঁর গণসংগীতের একটি রেকর্ড। গুরু শুভ গুহঠাকুরতার ‘দক্ষিণী’তে শুরু হয় তাঁর নিয়মিত রবীন্দ্রসংগীত-চর্চা। গণনাট্যের কার্যক্রমও অব্যাহত থাকে। একসময় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ‘দক্ষিণী’তেও। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলে কলকাতায় আবার দাঙ্গা শুরু হয়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ১৯৫০ সালে চলে আসেন ঢাকায়। তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে দিয়ে গানের রেকর্ড উদ্বোধন তাঁর জীবনের অবিস্মরণীয় ঘটনা। নানামুখী কর্মের পাশাপাশি সংগঠন তৈরি ও পরিচালনাও অব্যাহত থাকে। প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার জন্যে বিভিন্ন সময় পাকিস্তান সরকারের রোষানলেও পড়তে হয় তাঁকে। সংগীত সাধনার পাশাপাশি একসময় চলচ্চিত্র পরিচালনায়ও নিজের নাম লেখান। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় টিভি সেন্টার চালু হলে তিনি ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দেন। রবীন্দ্রসংগীতপ্রীতির জন্যে সে-চাকরিতে ইস্তফাও দিতে হয়। ছিলেন উদীচীর উপদেষ্টা। বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের জেনারেল ম্যানেজারও ছিলেন। সংগীতশিক্ষার প্রতিষ্ঠান ‘সঙ্গীত ভবনে’র প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষও ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রসংগীতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় একুশে পদক ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার।
ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন ক্যানভাসের ‘আলোকিত ব্যক্তিত্ব’ বিভাগে এই কৃতী মানুষটির জীবন ও কর্ম নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ ফিচার লেখার লক্ষ্যে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলাম ২০০৭ সালের ১ অক্টোবর ঢাকার নিউ বেইলি রোডের বেইলি হাইটসে। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক আমাদের শোনালেন তাঁর জীবনের জানা-অজানা সব গল্প। আর সেই সাক্ষাৎকারের আলোকেই তৈরি করেছিলাম ক্যানভাসের সেই লেখাটি। বরেণ্য এই রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মৃত্যুবরণ করেন ২০১০ সালের ২ নভেম্বর। মৃত্যুর এক দশক পর এসে মনে হলো পুরো সাক্ষাৎকারটি এখনই গ্রন্থনা করা দরকার। আর এ-চিন্তা থেকেই পুরো সাক্ষাৎকারটি ভবিষ্যতের পাঠকদের জন্যে সযত্নে গ্রন্থনা করা হলো। – লেখক
মতিন রায়হান : কেমন আছেন আপনি?
কলিম শরাফী : ভালো আছি। আপনারা?
মতিন রায়হান : আমরাও ভালো আছি। শুরুতেই আপনার জন্ম, জন্মস্থান ও শৈশবের কথা শুনতে চাই।
কলিম শরাফী : আমার জন্ম নানাবাড়িতে। ১৯২৪ সালের ৮ মে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার খয়রাডিহি গ্রামে। আমার বাবার নাম সৈয়দ সামী আহমেদ শরাফী। আর মায়ের নাম বেগম আলিয়া। আমাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন ঢাকার সোনারগাঁওয়ের বাসিন্দা হজরত আবু তামামার শিষ্য ও জামাতা মাখদুম শারফুদ্দীন ইয়াহিয়া মানেরি। ইয়াহিয়া মানেরি ছিলেন বিহার শরিফের পির। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল সিনেমা হলের ব্যবসা। আমার বাবাকেও সিনেমা হল দেখাশোনা করতে হয়েছে। মাত্র চার বছর বয়সেই মাকে হারাই। মায়ের মৃত্যুর স্মৃতি এখনো আমার মনে গেঁথে আছে।
মতিন রায়হান : আমাদের তা শোনাবেন?
কলিম শরাফী : নিশ্চয়ই। মাকে যখন হারাই তখন আমার বয়স মাত্র চার। আমাদের বাড়িটি ছিল শহর থেকে একটু দূরে। মা খুব অসুস্থ। মামা তাড়াহুড়ো করে ডাক্তার আনতে চলে গেলেন শহরে। বাড়ির সবার মন খারাপ। মায়ের চারপাশ ঘিরে সবাই সেবা করছে। কেউ কেউ আবার কাঁদছেন। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন কখন মামা ডাক্তার নিয়ে আসবেন! অল্প সময়ের মধ্যেই মামা ডাক্তার সাহেবকে নিয়ে বাড়ি এলেন। ডাক্তার সাহেব অনেকক্ষণ ধরে মাকে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। আমার মামা তখন আমাকে অতি আদরে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন। আর ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছেন। একসময় ডাক্তার সাহেব মুখ ভার করে বললেন : ‘কোনো আশা নেই!’ সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির সবার মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গেল। সবাই আমাকে আদর করছে, কোলে নিচ্ছে। আস্তে আস্তে পাড়া-প্রতিবেশী আর আত্মীয়স্বজনে বাড়ি ভরে গেল। মা কথা বলছেন না, চোখ খুলছেন না। চুপচাপ শুয়ে আছেন। সবাই মায়ের মুখ দেখছেন। একপর্যায়ে মাকে ঘরের বাইরে নেওয়া হলো। কেউ বলছেন, তাড়াতাড়ি লাশের গোসল দাও। দাফনের ব্যবস্থা করো। মাকে গোসল দেওয়া হলো। সাদা কাফনের কাপড় পরানো হলো। কবর খোঁড়ার সময় মামা আমাকে কবরস্থানে নিয়ে গেলেন। আমি কবর খোঁড়া দেখলাম। জানাজার পর কবরস্থানে মায়ের লাশ দাফন করা হলো।
এসব ঘটনার সবই আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমার এও মনে আছে, মা মারা যাওয়ার তিন-চারদিন আগে আমাকে জড়িয়ে ধরে নানিকে বলেছিলেন : ‘মা, আপনি আমার বাচ্চাদের দেখবেন; আমি মনে হয় আর বেশিদিন বাঁচবো না!’
মতিন রায়হান : খুব অল্প বয়সে মাকে হারালেন!
কলিম শরাফী : হ্যাঁ। কিন্তু চোখের সামনে মায়ের মৃত্যুর ঘটনাটি সেই শৈশবে বুঝে উঠতে পারিনি। তারপর আমি নানির আদরেই বড় হয়েছি। কিছুকাল পরে আব্বা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। আমি বড় হয়ে আব্বার সংসারেই ছিলাম। আমার নতুন মাও আমাকে আদর-স্নেহ করতেন। আমার মায়ের স্মৃতি এখনো আমার মনে জীবন্ত হয়ে আছে।
মতিন রায়হান : আপনার ছেলেবেলার কথা শুনতে চাই।
কলিম শরাফী : মায়ের মৃত্যুর পর আমার ছেলেবেলা কেটেছে নানাবাড়িতেই। নানি ও মামাদের স্নেহ এবং আদরে বড় হয়েছি। নানাদের গ্রামে যেন সারাবছরই উৎসব লেগে থাকতো। সেসব উৎসবে মেঠো, ঝুমুর, লেটো ইত্যাদি গান হতো। একটু দূরের হিন্দুপাড়ায় রোজ সন্ধ্যায় কীর্তন হতো। আমরা ঘরে বসেই সেসব শুনতে পেতাম। সেই দিনগুলো খুব মধুর ছিল।
মতিন রায়হান : আপনার লেখাপড়ার হাতেখড়ি কীভাবে হলো?
কলিম শরাফী : নানার বাড়িতেই আরবি ওস্তাদজি ও বাংলা পণ্ডিত মশাইয়ের কাছে আমার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। ১৯২৯ সালে আমাকে তাঁতিপাড়া পাঠশালায় ভর্তি করা হলো। এখানে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করি। তারপর কলকাতায় বাবার কাছে চলে যাই। সেখানে ১৯৩৪ সালে আবার তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। সেন্ট বার্নাবাস স্কুলে। তার পরের বছর ক্যালকাটা মাদ্রাসায় অ্যাংলো-পার্শিয়ান বিভাগে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হই। মাদ্রাসার ইংরেজি বিভাগে পড়তে থাকি।
শৈশবে স্যারের সঙ্গে সুর করে পড়া মুখস্থ করতাম। শিক্ষার এই পদ্ধতিটা শিশুদের জন্যে বেশ কার্যকরী। এভাবে পড়তে পড়তে ছাত্ররা যা শিখতো, তা সারাজীবনের জন্যে মনে গেঁথে যেতো।