ক্রিস্টোফার চার্লস বেনিনজার
পরিচিতি : ক্রিস্টোফার চার্লস বেনিনজার, যিনি শুধু ক্রিস্টোফার বেনিনজার নামেই পরিচিত। তিনি ১৯৪২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার অধ্যাপক। তিনি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) নগর পরিকল্পনা ও হার্ভার্ডের গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব ডিজাইনে স্থাপত্যবিদ্যা পড়েছেন।
ক্রিস্টোফার বেনিনজার অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তির সঙ্গে কাজ করেছেন। ১৯৭১ সালে বি ভি দোশির আমন্ত্রণে তিনি হার্ভার্ডের চাকরি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে ভারতে চলে আসেন। তিনি আহমেদাবাদে স্কুল অব প্ল্যানিং স্থাপন করেন। ১৯৮৪ সালে ইউনাইটেড নেশনস কমিশন অন হিউম্যান সেটেলমেন্টের থিম পেপার রচনা করেন তিনি। এরপর ১৯৮৬ সালে তিনি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের আমন্ত্রণে নগর উন্নয়নের পজিশন পেপার রচনা করেন। নগর উন্নয়নের জন্য যে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে, এই যুক্তি তিনিই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের বাসস্থান ও নাগরিক-সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নানা উদ্যোগের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন, যার মধ্যে কলকাতার বস্তি উন্নয়ন কর্মসূচির কথা উল্লেখ করা যায়। নগর দরিদ্রদের জীবনমান উন্নয়নে তিনি একজন নিবেদিতপ্রাণ স্থপতি। তিনি মনে করেন, স্থপতিদের কাজ স্তম্ভ নির্মাণ করা নয়, তাঁদের কাজ দরিদ্র মানুষের আবাসন নির্মাণ করা।
সম্প্রতি বেঙ্গল পাবলিকেশনস থেকে তাঁর বই লেটার্স টু আ ইয়াং আর্কিটেক্টের বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনি মার্চে ঢাকায় আসেন। তখন সমাজতাত্ত্বিক, গবেষক ও ত্রৈমাসিক প্রতিচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক খন্দকার সাখাওয়াত আলী এবং বইটির অনুবাদক প্রতীক বর্ধন তাঁর সাক্ষাৎকার নেন।
প্রশ্ন : আপনি তো অনেক দিন ধরে ভারতে আছেন। অনেকে আপনাকে মার্কিন-ভারতীয় স্থপতিও বলে থাকেন। ভারতীয় সমাজ ও মার্কিন সমাজের মধ্যে কী পার্থক্য দেখেন?
ক্রিস্টোফার বেনিনজার : প্রথমত, আমি যদি পারতাম তাহলে ভারতীয় নাগরিক হতাম। আমার অনেক ভারতীয় বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। সেখানে কয়েক বছর থাকার পর তাঁরা মার্কিন নাগরিকত্বও পেয়েছেন। আমি ১৯৭১ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ভারতে থাকছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমি ভারতীয় নাগরিকত্ব পাইনি হ্যাঁ, আমার সম্পদ আছে, ব্যাংক হিসাব আছে; আমি শুধু ভোটটা দিতে পারি না। এতকাল থাকার পর আমাকে ভারতে বসবাসরত বিদেশি নাগরিকের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় নাগরিক হতে পারলে আমি নিজেকে গর্বিত মনে করতাম। ধারণা করি, বাংলাদেশেও আমি নাগরিকত্ব পেতাম না। ব্যাপারটা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসীদের জন্য দরজা খুলে রেখেছে। তারা অভিবাসীদের কোটা কিছুটা হ্রাস করলেই এখানকার মানুষের মন দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। ভারত নিজের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করতে পাঠাতে চায় কিন্তু আমাদের নাগরিকত্ব দিতে চায় না। তবে অনেকে যে আমাকে ইন্দো-মার্কিন স্থপতি বলে থাকেন, সেটা আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়। মার্কিন সমাজে এটা করা হয় না। সেখানে জাতি বা ধর্মগত পরিচয়ে কারো গায়ে লেবেল সেঁটে দেওয়া পরচর্চার শামিল।
প্রশ্ন : ভারতে আসার পর প্রথমদিকে কী কী কাজ করলেন? সেগুলোর বৈশিষ্ট্য কী?
ক্রিস্টোফার বেনিনজার : আপনারা জানেন, আমি বালকৃষ্ণ দোশির আমন্ত্রণে ভারতে চলে আসি। যদিও মীর মোবাশ্বার আলীর সঙ্গে আমার পূর্ব পাকিস্তানে আসার কথা ছিল, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে আমার আর আসা হয়নি। ১৯৭১ সালে আমি যখন পাকাপাকিভাবে ভারতে চলে আসি, তখন আহমেদাবাদে স্কুল অব প্ল্যানিংয়ের কাজ শুরু করি। বরোদায় এক বন্ধুর জন্য আমি বিনামূল্যে কিছু কাজ করেছিলাম। সেই বন্ধু এরপর কংগ্রেসে যোগ দিয়ে গৃহায়নমন্ত্রী হন। এটাই হলো সৌভাগ্য। তিনি দোশিসহ আমাকে অনেক কাজে যুক্ত করেন। আমি তখন বয়সে অনেক তরুণ, অনেকেই আমার নাম দেখে আঁতকে উঠেছিলেন। আমার মন্ত্রীবন্ধু তাঁদের উদ্দেশে বললেন, ‘আপনারা যখন ঘুমাচ্ছিলেন, তখন এই তরুণ আমার জন্য কাজ করেছেন’। সেটা ছিল হাডকোর অর্থায়নে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষদের জন্য গৃহায়ন প্রকল্প; কিন্তু আমি ছাড়া অন্য কোনো স্থপতি কাজ শেষ করেননি। বিশ্বব্যাংক আমার প্রকল্প দেখতে এসে আঁতকে উঠল, কারণ তারা এর আগে ১০০ বর্গফুটের উঠানসহ ২০০ বর্গফুটের বাড়ি দেখেনি। প্রতিটি বাড়ির ছাদে যাওয়ার সিঁড়িও ছিল। গুজরাটের মানুষ ছাদে ঘুমাত বলে এই ব্যবস্থা রেখেছিলাম। তো বিশ্বব্যাংক আমাকে বলল, ‘আপনি মাদ্রাজের নগর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করুন’। আমি সেখানে গেলাম। কিন্তু তারা এক বা দুটি শয়নকক্ষের
যে-ঘর বানিয়েছিল তা নিম্ন আয়ের মানুষের সামর্থ্যের মধ্যে ছিল না। ফলে নিম্নমধ্যবিত্তও নয়, মধ্যবিত্তরা এসব ফ্ল্যাট কিনে নেয়। তখন আমি বললাম, আমাদের আশ্রয়ণ প্রকল্প করতে হবে, গৃহায়ন প্রকল্প নয়। মানুষকে আশ্রয় দিতে হবে, নির্মাণ প্রকল্প করার প্রয়োজনীয়তা নেই। আমি বললাম, আমাদের ৩০০ থেকে ৪০০ বর্গফুটের প্লট বানাতে হবে। প্লট যতই সংকীর্ণ হবে, ততই পানির পাইপ, বিদ্যুতের লাইন ও রাস্তার সঙ্গে তার দূরত্ব কমবে। মানে প্লট যত সংকীর্ণ ও গভীর হবে, ততই তার কার্যকারিতা বাড়বে। হার্ভার্ডে পড়ার সময় আমি এটা শিখেছি। মোদ্দা কথা হলো, এসব প্রকল্পের প্রাথমিক খরচ কম রাখতে হবে। সব পরিষেবা যাতে মানুষ পায় এবং সবকিছু যেন এই নিম্ন আয়ের মানুষের সাধ্যের মধ্যে থাকে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। সাধ্যের মধ্যে রাখার কথা বলছি যাতে এই মানুষেরা মাসে মাসে কিস্তি দিয়ে প্লটের মালিকানা পেতে পারে। মালিকানা পেলে তারা প্লটের উন্নয়নের চিন্তা করবে। এরপর তাদের সামাজিক নিরাপত্তার প্রশ্ন আসবে। এ বিষয়গুলো আমি তরুণ স্থপতিকে লেখা পত্রাবলি বইয়ে উল্লেখ করেছি। তারা যদি বোঝে, সরকার একদিন সেখান থেকে তাদের উচ্ছেদ করতে পারে, তাহলে তারা কখনো সেই ভূমির উন্নয়ন করবে না। আর এসব যদি তাদের সাধ্যের বাইরে চলে যায়, তাহলে নিম্নমধ্যবিত্তও নয়, দেখা যাবে, মধ্যবিত্তরাই এসব কিনে নেবে। তখন ১০ বছর পর লোকে বলবে, আমরা মধ্যবিত্তদের জন্য বিনা পয়সায় ভালো প্রকল্প করেছি। হ্যাঁ, মধ্যবিত্তদের সাধ্যের মধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্প করতে হবে। এরপর যতই আমি কাজ করতে থাকি, ততই মনে হতে শুরু করল, আমি আর নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কাজ করছি না; আমি রাজনৈতিক নেতাদের জন্য কাজ করছি। শ্রমিক নেতারা আমার প্রকল্প থেকে প্রচুর টাকা বানিয়েছে। এরপর আমি জলাধার, পানির নালা বাঁধাই, সেচ প্রকল্পসহ বস্তি উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করেছি। কথা হচ্ছে, ভারতের মানুষ এখনো গরিব। কিন্তু লোকে কথাটা বিশ্বাস করতে চায় না। বলা হয়, ভারতের ৩০ শতাংশ মানুষ মধ্যবিত্ত। কিন্তু দেশটির মাত্র ১ দশমিক সাত শতাংশ মানুষ আয়কর দেয়। স্বাস্থ্যবীমা আছে তিন শতাংশ মানুষের। মধ্যবিত্তের তো তিন স্বাস্থ্যবীমা থাকার কথা। তাই আমার হিসাবে দেশটির তিন শতাংশ মানুষ মধ্যবিত্ত। ভারতীয় শহরগুলোর ৬০-৭০ শতাংশ মানুষ এখনো অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে। এই মানুষেরা এখনো মৌলিক পরিষেবা পায় না।