গ্রীষ্মবিদায়ের কাব্য

মনজুরুল হক
চার ঋতুর দেশ জাপানে প্রতিটি ঋতু তার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে ধরা দেয়। ফলে ঋতুর পালাবদলও উৎসাহী মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। গ্রীষ্মের সেরকম এক নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সিকাডা বা ঘুর্ঘুরে পোকার বিরামহীন কান্না। এই কান্নার মধ্যেও সময়ের হেরফের লক্ষণীয়ভাবে ফুটে ওঠে। গ্রীষ্মের শুরু আর শেষদিকের সেই কান্নার সুরে বিস্তর পার্থক্য লক্ষ করা যায়। শুঁয়োপোকার আকারের এই ঘুরঘুর পোকা বিরামহীন কান্নার মধ্যে দিয়ে প্রজাপতিতে  রূপান্তর হয়ে অচিরেই প্রকৃতির মাঝে বিলীন হয়ে যায়। ঘুরঘুরে পোকার কান্না স্তিমিত হয়ে আসা তাই গ্রীষ্মের সমাপ্তির আভাস জাপানে দেয়। তবে গ্রীষ্মকাল শেষ হয়ে আসার আরো বেশি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত যে পতঙ্গের ডাকে অনেক বেশি প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে, জাপানি ভাষায় সেটা সুজুমুশি নামে পরিচিত। এর আনুষ্ঠানিক ইংরেজি নাম হচ্ছে রিং বেল ক্রিকেট, বাংলায় যাকে কিনা ঘণ্টাবাদক ঘাসফড়িং বলা যেতে পারে। সুজুমুশি দেখতে অবশ্য মোটেও ঘাসফড়িংয়ের মতো নয়, বরং অনেক ছোট আকারের পতঙ্গ এটা। এর ডাক অনেকটা শোনায় যেন মৃদু ঘণ্টাধ্বনির মতো। তবে দলবদ্ধভাবে এদের বসবাস হওয়ায় এদের সম্মিলিত কান্না বেশ জোরালো ঘণ্টাধ্বনির মতোই বেজে ওঠে। এই সুজুমুশির আগমন জাপানে পরিষ্কারভাবে বলে দেয়, গ্রীষ্মের সমাপ্তি আসন্ন এবং প্রকৃতির জীবনচক্রে পালাবদলের প্রস্তুতিও তাই শুরু হওয়ার পথে।
জাপানের প্রচলিত নিজস্ব ধর্মাচার শিন্তো মতবাদে প্রকৃতির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কামি বা ঈশ্বর প্রকৃতির নানারকম শক্তির মধ্যে উপস্থিত বলে শিন্তো ধর্মবিশ্বাসীরা মনে করেন। ফলে প্রকৃতির রূপান্তরের পর্বকে বিশেষ প্রার্থনা আর কাগুরা বা ঈশ্বরবন্দনার নাচের মধ্যে দিয়ে পালন করার রীতি দূর অতীতকাল থেকেই জাপানে অনুসরণ করা হচ্ছে। গ্রীষ্মকে বিদায় জানানোর সেরকম আয়োজনে বাক্সবন্দি একদল সুজুমুশিকে প্রকৃতির কোলে ছেড়ে  দেওয়ার মধ্যে দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় বন্ধনের প্রতিফলনই যেন ফুটে ওঠে।
জাপানে গ্রীষ্মের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি কিছুদিন আগে ঘটেছে, যদিও গরমের দাপট এখনো কিছুটা হলেও আঁচ করা যায়। গ্রীষ্মকে বিদায় জানানোর কাব্যিক এক আয়োজন সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বসেছিল টোকিওর অল্প দূরে অবস্থিত প্রাচীন রাজধানী শহর কামাকুরার বিখ্যাত শিন্তো মন্দির ‘সুরুগাওকা হাচিমানগু’তে। কামাকুরা শহরের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত এই শিন্তো মন্দিরের আছে সমৃদ্ধ এক ইতিহাস। দূরঅতীতে জাপানের পূর্বাঞ্চলে মিনামোতো যোদ্ধা পরিবার তাদের শৌর্য আর বীরত্বের জন্য সুপরিচিত ছিল। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষদিকে এ-পরিবারের প্রধান মিনামোতো ইয়োরিতোমো তাইরা পরিবারকে যুদ্ধে পরাজিত করে জাপানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন। জাপানের রাজধানী তিনি তখন কৌশলগত কারণে কামাকুরায় সরিয়ে আনলে শহরের শিন্তো ধর্মমন্দিরটি তখন তৎকালীন রাজনীতিরও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। মিনামোতো ইয়োরিতোমোর পূর্ব প্রজন্মের প্রতিনিধি মিনামোতো ইয়োরিইয়োশি ১০৬৩ সালে মন্দিরটি প্রথম গড়ে তোলেন। তবে ইয়োরিতোমো দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী সমরনায়ক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করার পর দ্বাদশ শতাব্দীর শেষদিকে ৎসুরুগাওকা হাচিমানগু শিন্তো মন্দির তিনি এর বর্তমান জায়গায় সরিয়ে আনেন।
১১৯২ সালে মিনামোতো ইয়ুরিতোমো আনুষ্ঠানিকভাবে শোগুন বা প্রধান সমরনায়কের পদে অধিষ্ঠিত হলে কামাকুরার শিন্তো মন্দিরের গুরুত্ব অনেক  বেড়ে যায়। পরবর্তীকালে মিনামোতো বংশের পতনে জাপানে ক্ষমতার হাতবদলের মধ্যে দিয়ে রাজধানী আবারো কিওতোতে ফিরে গেলেও ৎসুরুগাওকা হাচিমানগু দেশের শিন্তো ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে প্রধান একটি মন্দির হিসেবে সবসময় গণ্য হয়ে এসেছে। ধর্মাচারের সঙ্গে সম্পর্কিত ধ্র“পদী সংগীত ও নৃত্যের পর্যায়ক্রমিক উত্তরণেও মন্দিরের ভূমিকা জাপানজুড়ে স্বীকৃত। মধ্য সেপ্টেম্বরে মন্দিরচত্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *