জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ বিলিয়ন ডলার মিররে ইউনিভার্সের সন্ধান

 অপূর্ব চৌধুরী

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। ছোট করে বলে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। ইংরেজিতে সংক্ষিপ্তাকারে বা james Webb Space Telescope.
মানুষ এখন পর্যন্ত যত টেলিস্কোপ তৈরি করেছে তার মধ্যে জেমস টেলিস্কোপটি সবচেয়ে শক্তিশালী। আমেরিকান বিজ্ঞানী দিয়েত্রিচ করস্ (Dietrich Korsch) ১৯৭২ সালে তিনটি ‘মিরর’ (আয়না) সম্পন্ন যে করস্ (korsch) টেলিস্কোপের মডেল তৈরি করেন, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপটি সেরকম করে বানানো। ইনফ্রারেড রেজুল্যুশনকে অনেক বাড়িয়ে ধুলোবালির আড়ালে ঢেকে পড়া স্পেসের ক্ষীণ আলোর তরঙ্গকে ধরতে এই টেলিস্কোপটি বেশ শক্তিশালী। স্পেস থেকে স্পেসকে দেখার জন্যে এই ধরনের  টেলিস্কোপ ব্যবহার করা হয়। ইউনিভার্সের বিশালতাকে আরো গভীরে পর্যবেক্ষণ করা হবে এই টেলিস্কোপ দিয়ে। যদিও জেমস টেলিস্কোপের আগে সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ হাবল টেলিস্কোপ দিয়ে সীমিত আকারে সে-কাজগুলো করা হতো। এখন জেমস স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে আরো বিস্তৃত পরিসরে কাজ করা হবে।

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের মূল আয়নাটি ১৮টি হেক্সাগনাল অংশ সেগমেন্টে ভাগ করা, মোট দৈর্ঘ্য ২১ ফুট চার ইঞ্চি। গোল্ড প্লেটেড বেরিলিয়াম উপাদান দিয়ে তৈরি আয়নাটি। হাবল টেলিস্কোপ ছিল ৭ ফুট ১০ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যরে আয়নার। সবমিলিয়ে হাবল টেলিস্কোপের চেয়ে জেমস টেলিস্কোপ ছয়গুণ বেশি আলো সংগ্রহ করতে পারে।

১৯৯০ সালে নাসা এবং ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির যৌথ উদ্যোগে তৈরি করা হাবল টেলিস্কোপ স্পেসে পাঠানো হয়েছিল।

জেমস স্পেস টেলিস্কোপটি দুটি দেশ এবং একটি মহাদেশের তিনটি স্পেস এজেন্সির সমন্বয়ে তৈরি করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নাসা, কানাডার সিএসএ এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ইএসএর বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় এটি বানানো হয়।

টেলিস্কোপটি প্রস্তুত করতে খরচ হয়েছিল ১০ বিলিয়ন ডলার। যদিও শুরুতে বাজেট ছিল মাত্র ৫০০ মিলিয়ন ডলার। বিশ বছরে তার খরচ বিশগুণ বেড়ে যায়। এটির মূল কাজ শুরু হয় ১৯৯৬ সালে, শেষ হয় ২০১৬ সালে।

মার্কিনি থিয়েট্রিক্যাল ফিজিসিস্ট লেহম্যান স্পিৎজার ১৯৪৬ সালে প্রথমবারের মতো মহাকাশে টেলিস্কোপ রেখে মহাকাশকে পর্যবেক্ষণের ধারণা দেন বিশ্ববাসীকে। তবে ধারণা করা হয়, গত শতকের ত্রিশের দশকেই এ নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানীদের ভাবনা ছিল এবং বিজ্ঞানীরা আশাবাদী ছিলেন যে, একদিন স্পেস টেলিস্কোপের ধারণাটি সফল হবে। তারই ফসলস্বরূপ আমেরিকার ১৯৬৮ সালের OAO-2 এবং রাশিয়ার ১৯৭৪ সালের Orion 1 নামের স্পেস টেলিস্কোপ দুটো বিশ্ববাসী মহাকাশে দেখতে পান।

প্রথম টেলিস্কোপ আবিষ্কার হয় ৪০০ বছর আগে। ১৬০৮ সালে ডাচ বিজ্ঞানী জোহান লিপারশে (Johann Lippershey) নেদারল্যান্ডসে এটি আবিষ্কার করেন। যদিও অনেকে মনে করেন, ইতালিয়ান বিজ্ঞানী গ্যালিলিও প্রথম টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেন। গ্যালিলিও শুধু জোহানের টেলিস্কোপটির কিছু উন্নতি করেন মাত্র।

মহাকাশের আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগে, সঙ্গে দূরত্ব, ধূলি, পৃথিবীর আবহাওয়া, বাতাস সে-আলো আসতে বাধা দেয়। এসব দেয়াল অতিক্রম করে টেলিস্কোপটিকে একটি উচ্চতায় রাখলে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ সহজ হয়।

অনেক সমস্যা পেরিয়ে গত বছর ২৫শে ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপটিকে মহাকাশে স্থাপনের কাজ শুরু হয়। Ariane VA256 নামের রকেট টেলিস্কোপটি নিয়ে যায় মহাকাশে স্থাপনের জন্যে। মূল কাজগুলো নাসার স্পেস সেন্টারে হলেও উৎক্ষেপণ করা হয় গায়ানার কোউরু (Kourou) স্পেসপোর্ট থেকে। এটি তৈরি করতে ২০ বছরে ১৪টি দেশের ২৫৮টি কোম্পানির ১০ হাজার বিজ্ঞানী এবং টেকনিশিয়ানের সাহায্য লেগেছে।

এই টেলিস্কোপটি যে-পয়েন্টে রাখা হবে মহাকাশে তার নাম : Lagrange point ev L2, যেখানে  সূর্য এবং পৃথিবীর গ্র্যাভিটেশন ফোর্স তুলনামূলক কম এবং স্থির। এই পয়েন্ট পৃথিবী থেকে দেড় মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে। এটি তার মূল কাজ শুরু করতে গিয়ে ৩০০টি ভুলের সম্মুখীন হতে পারে। ঠিকমতো কাজ শুরু করতে একে ১৭৮টি মুভমেন্ট এবং মেকানিজম করতে হবে।

এই টেলিস্কোপের নাম জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ নেওয়া হয়েছে নাসার দ্বিতীয় অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হেড জেমস এডুইন ওয়েব (James Edwin Webb)-এর ১৯৬১ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত নাসার কাজের কৃতিত্বকে স্মরণ করে। ১৯৯২ সালে তিনি মারা যান। ২০০২ সালে প্রথম প্রস্তাব করা হয় নেক্সট স্পেস টেলিস্কোপের নাম হবে তাঁর নামানুসারে।

গত ত্রিশ বছর ধরে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ মহাশূন্য সম্পর্কে, মহাকাশের বিশাল অস্তিত্ব সম্পর্কে, মিলিয়ন মিলিয়ন মাইল দূরে স্টার থেকে গ্যালাক্সি, সুপারনোভা থেকে ব্ল্যাক হোল, গ্যাসের কুণ্ড থেকে তারার জন্ম-মৃত্যু, অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। হাবল টেলিস্কোপের চেয়ে কয়েকগুণ শক্তিশালী জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে মহাবিশে^র আরো গভীরে, আরো দূরে, আরো স্পষ্ট করে, আরো বেশি তথ্যে সমৃদ্ধ মহাকাশ সম্পর্কে জানা সম্ভব হবে।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপে দুটি মূল আয়না। একটি প্রাইমারি, আরেকটি সেকেন্ডারি। যদিও আরেকটি স্ট্যাটিক টার্শিয়ারি মিরর আছে এতে। প্রাইমারিটি মূল মিরর, দ্বিতীয়টি সহকারী। প্রাইমারি অনেক বড়। সে তুলনায় সেকেন্ডারিটি কয়েকগুণ ছোট।

প্রাইমারি মিররটির কাজ আলো সংগ্রহ, সেকেন্ডারি মিররটি প্রাইমারির সেই আলোকে টেলিস্কোপের ইন্সট্রুমেন্টে পাঠানোর কাজটি করে।

প্রাইমারি মিররটির দৈর্ঘ্য সাড়ে ছয় মিটার। স্বর্ণের প্রলেপ বসানো এই মূল মিররটি বেরিলিয়াম নামক হালকা; কিন্তু খুব শক্ত পদার্থ দিয়ে তৈরি।

এতো বড় আর এতো ভারি আয়নাটিকে কী করে স্পেসে নিয়ে যাওয়া যাবে – সে-চিন্তা থেকে বিজ্ঞানীরা প্রথমে আয়নাটিকে ১৮টি ভাগে ভাগ করলেন। প্রতিটি ভাগের ওজন ৪৬ পাউন্ড বা ২০ কিলোগ্রাম। মূল আয়নাটির ১৮টি সেগমেন্ট এক করলে দৈর্ঘ্য একুশ ফুট দশ ইঞ্চি হলেও প্রতিটি সেগমেন্টের দৈর্ঘ্য ৪.৩ ফুট।

আঠারো ভাগের উদ্দেশ্য ছিল যাতে ফ্ল্যাট করা এতো বড় আয়নাকে নিতে না হয়। আঠারোটি সেগমেন্টকে ফুলের পাপড়ির ভাঁজের মতো ভাঁজে ভাঁজে রেখে ছোট করে একটি রকেটের ভেতরে ভরে স্পেসে পাঠানো হয়েছে প্রথমে। তারপর সে রকেট একটি দূরত্বে যাওয়ার পর মিররটিকে সেখান থেকে বের করে ফুলের পাপড়ি মেলার মতো ছড়িয়ে দিয়ে ফ্ল্যাট করা হয়েছে। এমন করেই বিশাল আকৃতির একটি মিররকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ এবং ভাঁজ করে ছোট করে মহাকাশে পাঠানো হলো।

আঠারোটি সেগমেন্টকে প্রথমে তিনটি ভাগে ভাগ করে হয়েছে। প্রতিটি ভাগে ছয়টি করে সেগমেন্ট। প্রতিটির পেছনে একটি করে মোটর বসানো। তিনটি ভাগকে ভাঁজ করে এমন করে রাখা হয়েছে শুরুতে, যাতে একটি রকেটের ভেতর ঢুকিয়ে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে নিয়ে রকেট থেকে বের করে মেলে ধরা যায়।

প্রথমত আঠারোটি সেগমেন্ট এক করলে মিররটি দেখতে গোলাকৃতি হয়ে ওঠে। মিররটি গোলাকৃতি করার কারণ হলো এতে আলো সমানভাবে প্রতিফলিত হবে। ওভাল আকৃতির হলে আলো একপাশে বেশি পড়লে আরেকপাশে কম পড়তে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *