পুনশ্চ মস্কো

 মনজুরুল হক

শেষবার মস্কোর সাক্ষাৎ আমি পেয়েছিলাম আজ থেকে চলিস্ন­শ বছর আগে। সেবার হঠাৎ করেই আমার মস্কো ছেড়ে যাওয়া। সাত বছর সেই শহরে বসবাসের পাততাড়ি গুটিয়ে আমার সেই চলে যাওয়া ছিল সাময়িক। তবে সেই সাময়িক যাত্রাই শেষ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে শহর ত্যাগ হয়ে ওঠে এবং এরপর চার দশকে সেই পথে আমার আর পা বাড়ানো হয়নি। ১৯৮০ সালের মে মাসে আমি যখন মস্কো ছেড়ে চলে এসেছিলাম, সেই শহর তখন ছিল হারিয়ে যাওয়া দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী। এরপর দীর্ঘ প্রায় চার দশক সেই দেশটিতে আমি আর যাইনি, যদিও স্মৃতির পাতায় অমস্ন­vন থেকে গেছে আমার সাত বছরের মস্কোজীবনের নানা খুঁটিনাটি দিক। সেই স্মৃতির খানিকটা আমি মনের গভীর অতল থেকে তুলে আনার চেষ্টা করেছি স্মৃতিচারণমূলক বই আমার প্রবাস জীবন : সোভিয়েত পর্বে।গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বেঙ্গল আমার সেই বইটি প্রকাশ করেছে।

মস্কোর সেই স্মৃতিকথা লেখা শেষ করার আগে আমি সেই শহরে এ-কারণে যেতে চাইনি যে, আমার আশঙ্কা ছিল মধুর যেসব স্মৃতি মস্কোকে ঘিরে রয়েছে, তা হয়তো পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে কিছুটা হলেও রং হারিয়ে ফেলতে পারে। ফলে আমার যৌবনের ফেলে আসা শহরে আবারো যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও মনের গভীরে সযত্নে ধরে রেখেছি সেই বাসনা। বই প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর আসলেই যেন ভারমুক্ত মনে হয়েছে নিজেকে এবং তখন থেকেই ভেবেছি এবার মস্কো ঘুরে এলে মন্দ হয় না। বিশেষ করে এ-কারণে যে, আমাদের চার দশকের বিবাহিত জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল সেই মস্কোতে এবং একমাত্র কন্যা এখন নিজের জীবন শুরু করতে যাওয়ায় আমরা হয়ে উঠেছি ভারমুক্ত ও সেইসঙ্গে কিছুটা হলেও     স্মৃতিকাতর। ফলে স্ত্রী ইউমিকোর পক্ষ থেকেও পরোক্ষ তাগিদ ছিল দীর্ঘ বিরতির পর আমাদের যৌবনের সেই স্মৃতির শহরকে একবার দেখে আসার। সে-অনুযায়ী পরিকল্পনা করে গত বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আমরা যাত্রা করেছিলাম মস্কোর উদ্দেশে। মনে আশঙ্কা থেকে গিয়েছিল, স্মৃতির সেই মস্কোর দেখা দীর্ঘ বিরতি আর নানারকম রদবদলের পর সেখানে গিয়ে হয়তো পাব না।

জাপান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট নয় ঘণ্টার পথ পার হয়ে দমোদিয়েদোভো বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর হঠাৎ করেই স্মৃতির দরজা খুলে যায় এবং শুরুতেই আমার মনে পড়ে যায় একই সেই বিমানবন্দর থেকে ঠিক চার দশক আগে আমি প্রথমবারের মতো যাত্রা করেছিলাম জাপানের উদ্দেশে। তবে শুধু এটুকুই। দমোদিয়েদোভোতে এদিকে-সেদিকে চোখ বুলিয়ে আগের সেই বিমানবন্দরকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে গেলেও সেটার দেখা আমি একেবারেই পাইনি। বিমানবন্দরটি তখন ছিল কেবলই অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের জন্য নির্ধারিত। ফলে শেরিমেতিয়েভো বিমানবন্দরের মতো সেখানে ছিল না ইমিগ্রেশন বা কাস্টমসের কাউন্টার। আর এখন সেটি আন্তর্জাতিক আকার নিলেও নতুন সেই দমোদিয়েদোভোর ইমিগ্রেশনে দেখা মেলেনি সোভিয়েত সীমান্তরক্ষী বাহিনীর যুবকদের ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি কিংবা সতর্কদৃষ্টির। এর বদলে যে-তরুণী আমার পাসপোর্ট পরীক্ষা করে দেখছিল, তার মুখে ছিল হাসি এবং জানতে চেয়েছিল কেন আমি মস্কো সফরে এসেছি। পাশের কাউন্টারে স্ত্রীর পাসপোর্ট শনাক্তের কাজ ততক্ষণে শেষ হয়ে গেছে এবং সেখানে বসা ইমিগ্রেশনের তরুণ এর মধ্যে জেনে গিয়েছিল যে চার দশক পর আমরা এসেছি আমাদের স্মৃতির শহর ঘুরে দেখতে। আমার পাসপোর্ট পরীক্ষা করে দেখা তরুণীকে সেই বার্তা সে পৌঁছে দেয় এবং তরুণী তখন রুশ ভাষায় আমাকে স্বাগত জানিয়ে বলে দেয় যে, আগের সেই মস্কোকে আমি খুঁজে পাব কিনা সেটা সে নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।

ইমিগ্রেশন আর কাস্টমসের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বাইরে বের হয়ে এসে আমি খোঁজ করছিলাম আমার নাম লেখা পস্ন­¨vকার্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সিচালকের, যে আমাদের নিয়ে যাবে নগরকেন্দ্রের স্যাভয় হোটেলে। এমনটাই আমাকে টোকিওতে জানিয়ে দিয়েছিল আমাদের ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দেওয়া কোম্পানি। না, কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না! কিছুটা হলেও আশঙ্কা আমি এ-কারণে বোধ করতে শুরু করি যে, পরিবর্তিত মস্কো সম্পর্কে যেসব সংবাদ গত কয়েক বছরে পাঠ করার সুযোগ আমার হয়েছে, তাতে করে বিমানবন্দর থেকে অপরিচিত ভাড়ার ট্যাক্সি নিয়ে শহরের পথে যাত্রা করায় খুব একটা ভরসা আমি পাচ্ছিলাম না। দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকা সেরকম এক সময়ে বিশালদেহী এক রুশ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে আমার নাম উচ্চারণ করে ভাঙা ইংরেজিতে জানতে চেয়েছিল আমি সেই ব্যক্তি কিনা। রুশ ভাষায় তাঁর প্রশ্নের উত্তর আমি দেওয়ায় সে কিছুটা অবাক হয়ে গেলেও একটু পরেই তাঁর মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে এবং রুশ ভাষায় আমাকে জানায় যে, ইংরেজি ভাষাটা সেভাবে রপ্ত করতে পারেনি বলে তাঁর মনে হচ্ছে আমি যেন পরিত্রাতার ভূমিকায় তাঁর সামনে উপস্থিত হয়েছি। এরপর থেকে চলতে থাকে রুশ ভাষায় তাঁর দিয়ে যাওয়া অনর্গল বর্ণনা এবং আমি তাৎক্ষণিকভাবে বুঝে উঠতে সমর্থ হই, জাতিসত্তার পরিচয়ের দিক থেকে রুশদের যে-আন্তরিকতা, সেটার কোনো পরিবর্তন চার দশকে হয়নি। নিজের ভাষা জানা থাকা বিদেশিদের এরা এখনো খুব সহজে আপন করে নিতে পারে। ট্যাক্সিচালকও ভ্রমণের কারণ জেনে যাওয়ার পর আন্তরিকভাবে আমাদের দুজনকে তাঁর শহরে স্বাগত জানিয়েছিল এবং এক সপ্তাহের অবস্থানে কোথায় কোথায় আমাদের যাওয়া দরকার, সেই উপদেশ দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *