ফুল বলে, ধন্য আমি …

রাস্কিন বন্ড

অনুবাদ : ভার্গব বন্দ্যোপাধ্যায়

ফার্ন হিল, দ্য ওকস্, হান্টারস্ লজ, দ্য পার্সোনেজ, দ্য পাইনস, ডাম্বারনি, ম্যাকিন্নন্স হল এবং উইন্ডারমেয়ার। ভারতের কোনো একটা পাহাড়ি শহরের চারপাশের অতিপ্রাচীন কয়েকটা বাড়ির নাম এগুলো। এগুলোর বেশির ভাগই ভেঙেচুরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বাড়িগুলো অনেক পুরনো, একশ বছরেরও আগে তৈরি। সমতলের অসহ্য গরমের হাত থেকে রক্ষা পেতে ব্রিটিশরাই তৈরি করেছিল বাড়িগুলো। বর্তমানের পর্যটকরা পাহাড়ি শহরের বাজার এলাকা বা সিনেমার কাছেই থাকতেই পছন্দ করে। আর ওক, ম্যাপল ও দেবদারুর মধ্যে তৈরি ওই পুরনো বাড়িগুলোর বাসিন্দা হচ্ছে বুনো বিড়াল, পেঁচা, ছাগল ও অন্যান্য প্রাণী আর তার সঙ্গে মাঝে মাঝে সাময়িক অবস্থানকারী হচ্ছে খচ্চর চালক এবং কাঠকয়লা প্রস্তুতকারী মানুষেরা।

কিন্তু এসব অবহেলিত, সুরম্য ভবনের মধ্যে দেখা যায় একটা পরিচ্ছন্ন, রং-ফেরানো বাড়ি। বাড়িটার নাম মালবেরি লজ। আর এই বাড়িটায় অল্প কিছুদিন আগেও মিস ম্যাকেঞ্জি নামে একজন বয়স্ক, অবিবাহিত ইংরেজ রমণী বাস করতেন।

কয়েক বছর আগেও তাকে বয়স্ক বললে ঠিক বলা হতো না, কারণ তার বয়স ছিল আশি বছরের অনেক ওপরে। কিন্তু সেটা বোঝা যেত না। তিনি ছিলেন পরিচ্ছন্ন, প্রাণবন্ত এবং পুরনো হলেও ভালোভাবে সংরক্ষণ করা পোশাক পরতেন। সপ্তাহে একদিন দুই মাইল হেঁটে শহরে যেতেন মাখন, জ্যাম আর সাবান কিনতে। মাঝে মাঝে ছোট এক বোতল ওডি কোলনও কিনতেন।

তিনি তাঁর বালিকা বয়স থেকেই এই পাহাড়ি শহরে বাস করে আসছেন। সময়টা ছিল বোধহয় প্রথম মহাযুদ্ধের আগে। যদিও তিনি কখনো বিয়ে করেননি, সে-কারণেই তাঁর জীবনে একাধিকবার প্রেম এসেছে, তবুও তিনি উপন্যাসের হতাশ প্রেমিকাদের মতো ছিলেন না মোটেও। তাঁর বাবা-মা মারা গেছেন, তাও প্রায় তিরিশ বছর হতে চলল। তাঁর ভাই-বোনেরাও মারা গেছেন। ভারতে তাঁর কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। তিনি সামান্য একটা চল্লিশ টাকার মাসোহারা আর নিউজিল্যান্ড থেকে পাঠানো তাঁর কোন যৌবনকালের বন্ধুর উপহার প্যাকেটের ওপর নির্ভর করে বেঁচে ছিলেন।

অন্যান্য নিঃসঙ্গ প্রবীণ ব্যক্তির মতো তাঁরও একটা পোষা প্রাণী ছিল। মেটি ছিল হলুদ চোখওয়ালা একটা বড়সড় কালো বেড়াল। তাঁর ছোট্ট বাগানে তিনি ডালিয়া, ক্রিসেনথিমাম আর গ্লাডিওলাসের চাষ করতেন। তাঁর কিছু অর্কিডও ছিল। তিনি চারাগাছ, বুনো ফুল, বৃক্ষ, পাখি এবং কীটপতঙ্গ সম্বন্ধে অনেক খবর রাখতেন। এসব নিয়ে তিনি কখনো গুরুত্বসহকারে পড়াশোনা করেননি; কিন্তু তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে দীর্ঘকাল বসবাস করার ফলে তাদের প্রতি তাঁর একটা সহমর্মিতা তৈরি হয়েছিল।

খুব সামান্য কয়েকজন মানুষ তাঁর কাছে আসা-যাওয়া করতেন। মাঝে মাঝে স্থানীয় গির্জার পাদ্রি আসতেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। মাসে একবার করে আসত ডাকপিয়ন, তাঁকে নিউজিল্যান্ড থেকে আসা উপহারের প্যাকেট বা তাঁর মাসোহারার কাগজ দিতে। একদিন অন্তর আসত গোয়ালা, লেডি এবং তাঁর বেড়ালের জন্য এক লিটার করে দুধ দিতে। মাঝে মাঝে তিনি বিনামূল্যে একজোড়া করে ডিম পেতেন। কারণ ডিমওয়ালা মনে রাখতেন, তাঁর সৌভাগ্যের দিনে মিস ম্যাকেঞ্জি তাঁর কাছ থেকে একসঙ্গে অনেক ডিম কিনতেন। তিনি ছিলেন একজন হৃদয়বান মহিলা। গোয়ালা এখনো তাঁর মধ্যে বিশোর্ধ্ব এক পরমা সুন্দরী নারীর ছবি দেখতে পান, যেমনটি এক নয় বছরের বালক বিস্ময় এবং বিহ্বলতা নিয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকত তাঁর দিকে।

এখন সেপ্টেম্বর মাস, বর্ষার আয়ু ফুরিয়ে আসছে। মিস ম্যাকেঞ্জির বাগানে আপনা থেকেই ক্রিসেনথিমাম ফুটতে শুরু করেছে। তাঁর মনে হচ্ছে, আগামী শীতকাল খুব মারাত্মক হবে। কারণ তিনি লক্ষ করেছেন, দিন দিনই ঠান্ডা সহ্য করা তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে উঠছে।

একদিন যখন তিনি তাঁর বাগানে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, দেখলেন এক স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে তাঁর কটেজের ঢাল থেকে বুনো ফুল তুলতে।

‘ওখানে কে?’ তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন। ‘এই ছেলে, তুমি ওখানে কী করছো?’

 ছেলেটা সতর্ক ভঙ্গিতে পাহাড়ের গা বেয়ে পালাতে চেষ্টা করল; কিন্তু পাইন নিড্লে পা পিছলে সে মিস ম্যাকেঞ্জির নামটারশিয়াম বেডের ওপর এসে পড়ল।

যখন সে বুঝল পালানোর আর কোনো পথ নেই, সে গালভরা এক হাসি দিয়ে বলল, ‘সুপ্রভাত মিস।’

ছেলেটি ছিল স্থানীয় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র। তার পরনে ছিল উজ্জ্বল লাল রঙের কোট আর লাল-কালো দাগ দেওয়া টাই। ভারতের সকল বিনয়ী স্কুলছাত্রের মতো সেও সব ভদ্রমহিলাকে ‘মিস’ নামে সম্বোধন করে।

‘সুপ্রভাত’ – মিস ম্যাকেঞ্জি বেশ কড়াভাবে উত্তর দিলেন।  ‘তুমি কি আমার ফুলের বেডের ওপর থেকে সরে দাঁড়াবে?’

ছেলেটি অতি সতর্কভাবে নমটারশিয়াম বেড থেকে সরে দাঁড়িয়ে মিস ম্যাকেঞ্জির দিকে তাকাল। চোখে তার করুণ দৃষ্টি, গালে টোল। তার প্রতি ক্রুদ্ধ হওয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *