ফ্লোরিডায় আদিবাসী শিল্পী উইন্ডড্যান্সার ও জ্বরতপ্ত পৃথিবী

মঈনুস সুলতান

দিনচারেক ধরে ফ্লোরিডায় আমেরিকার আদিবাসীদের মিউজিক ফেস্টিভাল নিয়ে মজে আছি। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন যুক্তরাষ্ট্রে ‘নেটিভ আমেরিকান’ বা ‘আমেরিকান ইন্ডিয়ান’ নামে পরিচিত। এদের নৃত্যগীতের এই বিচিত্র জলসাটি আয়োজিত হয়েছে মেলবোর্ন শহরের প্রান্তিকে, উইকাহাম নামক বিরাট পার্ক সংলগ্ন গাছ-বিরিক্ষ-হ্রদ ও হরিণে ভরপুর একটি উপবনে। আদিবাসীদের হরেক কিসিম গোত্র থেকে আগত নানা ধরনের সমঝদাররা উপবনে ক্যাম্পিংয়ের কায়দায় তাঁবু খাটিয়ে দিন গুজরান করছেন। আমি তাদের সঙ্গে শরিক হয়ে হালকা একটি তাঁবুতে ডেরা বেঁধেছি। 

 সকাল ও দুপুরে আয়োজিত পরপর দুটি নৃত্যগীতে ভরপুর অধিবেশনের পর, আমি ফুড-কার্টের সামনে পাতা চেয়ারে বসে স্যান্ডউইচের সঙ্গে এক পেয়ালা আইস-টি পান করি। তারপর ফিরে যাই তাঁবুতে। বিকালের ওষুধ-বিসুদ তাড়াহুড়া করে গিলে অতঃপর ফের রওনা হই, মিউজিক মাইফেলের মূল মঞ্চের দিকে। ওখানে উইন্ডড্যান্সার নামে সুখ্যাত একজন নেটিভ আমেরিকান শিল্পীর নৃত্যগীতের কথা আছে। এ-প্রোগ্রাম মিস করার প্রশ্নই ওঠে না। 

যাওয়ার পথে শাপলা পুকুরের মতো ছোট্ট হ্রদটি ঘুরে যাই। পাড় থেকে সামান্য দূরে ঘন ঘাসে ছাওয়া ফুট তিনেক উঁচু ডাঙার ঢালুতে একসারি গর্ত। প্রতিটি গর্তের মুখে বসে রোদ পোহাচ্ছে ভারি দেহের বেশ কয়েকটি স্থলচর কচ্ছপ। তাদের গলার নিচে ছড়ানো গুচ্ছ গুচ্ছ লেটুস পাতা। 

আদিবাসী নেটিভ আমেরিকানদের মধ্যে দীর্ঘ জীবনের প্রতীক কচ্ছপদের কদরদানি প্রচুর। আন্দাজ করি, মিউজিক মাইফেলে আগত কোনো আদিবাসী হয়তো কচ্ছপদের লেটুসপাতার প্রসাদ জুগিয়ে গেছেন। বিশাল একটি বুদবুদ পালের মতো ভেসে আসে। বুদবুদের সাবানগোলা ত্বকে আলো পড়ে ফুটে উঠেছে রামধনুর আভা। বর্ণাঢ্য গোলকটি ওক গাছের কাণ্ডে ধাক্কা খেয়ে বিস্ফোরিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে ধেয়ে আসে, পরপর খানিক ছোট সাইজের বুদবুদ-বৃত্ত। আমি ঘুরে ঘাড় বাঁকিয়ে রামধনুময় বৃত্তের উৎস খুঁজি।

হ্রদের জলঘেঁষে পা ছড়িয়ে দীর্ঘ ঘাসে বসেছেন মানুষটি। তাঁর কামানো মস্তকের তালুতে বৃত্তাকার শেইপের একগুচ্ছ চুল। তাতে সজারুর কাঁটা দিয়ে তৈরি সবুজ রঙের একখানা পাখা আটকানো। আদিবাসী এই ভদ্রসন্তানের হাতে জায়ান্ট সাইজের আতশি কাচের মতো দেখতে একটি ফ্রেম। তা বালতির সাবানগোলা জলে চুবিয়ে তিনি আয়েশ করে ফুৎকারে সৃষ্টি করছেন রংধনু-প্রতিফলিত বুদবুদ। 

তাঁর ঢোলা পিরহানের পিঠে বড় বড় হরফে কিছু লেখা। আমি বাক্য-দুটো আগ্রহ নিয়ে পাঠ করি, ‘রিলিজড্ ফ্রম প্রিজন ইন টু থাইজেন্ড ফাইভ। সিন্স দেন লস্ট ইন্টারেস্ট ইন ভায়োলেন্ট ক্রাইম।’ মানুষটি জেল খেটে ছাড়া পেয়েছেন দু-হাজার পাঁচ সালে, অর্থাৎ পুরো চোদ্দো বছর তিনি মুক্ত হালতে বিরাজ করছেন এবং আগ্রহ হারিয়েছেন হিংসাত্মক অপরাধে। ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য, তবে এ-ধরনের ব্যক্তিগত ঘোষণা শার্ট বা জ্যাকেটের পিঠে লিখে কাউকে ঘোরাফেরা করতে আমি ইতিপূর্বে দেখিনি! পুরুষটি নির্ঘাৎ ব্যতিক্রমী চরিত্রের। ভাবি, কাছে গিয়ে তাঁকে ‘হ্যালো’ বলে শুভেচ্ছা জানাবো।

‘মিঁয়াও মিঁয়াও’ আওয়াজে দীর্ঘ ঘাসের গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে আসে একটি মার্জার। সবুজাভ রঙে লোম রাঙানো বিড়ালটি বেজায় সুদর্শন। সে চোখের তারায় কৌতূহল ফুটিয়ে দরাজ স্বরে ফের ‘মিঁয়াও’ বলে লাফিয়ে ওঠে বুদবুদ-ওড়ানো মানুষটির কোলে। তিনি ঘুরে তাকিয়ে ভারি মিঠে করে হেসে বলেন, ‘আই অ্যাম ইনোসেন্ট নাউ।’ 

 আমি এগিয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে বলি, ‘আই অ্যাম সো গ্ল্যাড টু ফাইন্ড আউট দ্যাট ইউ আর ইনোসেন্ট। আর ওই যে হিংসাত্মক অপরাধের ব্যাপারে আপনি আগ্রহ হারিয়েছেন, এটা আমি খুব আপ্রিসিয়েট করি। অ্যাজ আ  ম্যাটার অব ফ্যাক্ট, আমি নিজেও একজন ননভায়োলেন্ট ব্যক্তি। আই অ্যাম শিওর, আই ক্যান বি আ ফ্রেন্ড অব ইয়োরস।’ 

আমরা পরিচিতি হই। করোটিতে সজারু কাঁটার পাখাওয়ালা পুরুষটির নাম নাথানিয়েল কলবার্ট। তাঁর শরীরে আদিবাসী মোহাক গোত্রের বেশ খানিকটা রক্ত আছে। তিনি বলেন, ‘পুরো পাঁচ বছর মেয়াদ খেটে বেরোনোর পর থেকে আমি সাত্ত্বিক হালতে দিনযাপন করছি।’ তারপর জানতে চান, ‘আর ইউ ইন্টারেস্টেড টু হিয়ার মাই সাইড অব দি স্টোরি?’ আমি ‘অবকোর্স’ বলে আগ্রহ দেখাই, তবে  সঙ্গে সঙ্গে একটি অজুহাতও হাজির করি, বলি, ‘লুক, মূল মঞ্চে বিকালের অনুষ্ঠান শুরু হতে যাচ্ছে, এটা মিস করতে চাই না, পরে না হয় আপনার সঙ্গে কথা বলবো।’ আমার অজুহাতে নাথানিয়েল কিছু মনে করেন না, বলেন, ‘আই আন্ডারস্ট্যান্ড ইয়োর ইন্টারেস্ট ইন মিউজিক। হয়তো আমাদের ফের দেখা হবে, তখন না হয় কথা বলা যাবে।’ 

আমি উঠে পড়ি। নাথানিয়েল পেছন থেকে বলে ওঠেন, ‘ওয়েট আ মিনিট প্লিজ, কোথাকার লোক আপনি – জানতে একটু কৌতূহল হচ্ছে যে।’ আমি জবাব দিই, ‘বাংলাদেশ।’ তিনি ফের জানতে চান, ‘ওয়াজ বাংলাদেশ নৌন অ্যাজ বেঙ্গল ইন দ্য পাস্ট?’ আমি সম্মতিসূচকভাবে মাথা হেলাই। 

তিনি মিঠে হেসে বলেন, ‘দেয়ার ইজ অ্যান ইন্টারেস্টিং কোইন্সিডেন্স। আমার বিড়ালটিও বেঙ্গল প্রজাতির। ডু ইউ থিংক অরিজিন অব দিস ক্যাট ইজ অলসো ফ্রম বেঙ্গল?’ এ-প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই, তাই অপারগতা প্রকাশ করে ফের গুডবাই বলি। নাথানিয়েল পেছন থেকে আওয়াজ দেন, ‘দিস ইজ দ্য বেস্ট ক্যাট ইন দিস হৌল ওয়ার্ল্ড, এভরিবডি লাভস্ হার।’ 

মঞ্চ থেকে বাঁশরী ও ঢোলকের আওয়াজ ভেসে আসছে, তাই আমি জোর কদমে ওদিকে এগোই। দু-পা সামনে বাড়তেই দেখি, ঘাস মাড়িয়ে খুব অন্তরঙ্গভাবে পরস্পরের কাছাকাছি হয়েছে দুটি স্থলকচ্ছপ। এদের দিনযাপনে প্রণয়-পিরিত কিংবা ডেটিং প্রথা প্রচলিত আছে কি না, বলা মুশকিল, তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এরা তাই করছে।

মঞ্চে দ্রুত পৌঁছানোর জন্য কোনাকুনি ফাঁড়ি-পথ ধরতেই, আধ-জংলা ট্রেইলে মাটিতে প্রোথিত একটি নারীমূর্তি দেখে থমকে দাঁড়াই! ‘ফরেস্ট স্পিরিট’ নামে এই ভাস্কর্যটির প্রতিকৃতি আগেও দেখেছি, আন্দাজ করি, শিল্পকর্মটি হয়তো কোনো অরিজিনালের নকল। 

ঘটনা যা-ই হোক, তার অভিঘাত ঠিকই আমাকে স্পর্শ করে। দিন-কে-দিন জঙ্গল যেভাবে উজাড় হচ্ছে, এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমেরিকার আদিবাসী সমাজ। বনানীকে তাঁরা প্রাণহীন স্রেফ কাঠ বিবেচনা করেন না। তাঁদের কাছে বন-জঙ্গলেরও আছে আত্মা এবং তা বুলডোজারে বিক্ষত হলে ব্যাপকভাবে সাফার করে তরুলতা। কাউকে হত্যা করে লাশ গুম করলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, সেরকম একটি অরণ্যকে উৎপাটন করলে তার আহত আত্মা আশ্রয় নেয় চাপ-চাপ মাটির তলায়, তার কবরের ওপর জমতে থাকে শ্যাওলার সবুজ স্তর। 

 আধ-জংলা ট্রেইল থেকে বেরিয়েই চলে আসি, মঞ্চ ঘিরে জড়ো হওয়া দর্শক-শ্রোতা ও তামেশগীরদের পরিসরে। এখানেও আসরের মধ্যিখানে প্রচুর জায়গা খালি রেখে স্থাপন করা হয়েছে আরেকটি প্রস্তরমূর্তি। তার চতুর্দিকে তাজা পত্রালি দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে বেদি। এই ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে গ্রিক আর্থ গডেস বা পৃথিবীর অধিষ্ঠাত্রী দেবীর রূপকলার অনুকরণে। অনুমান করি, আদিবাসী নেটিভ আমেরিকানদের মিউজিক মাইফেলের হিল্লা ধরে এ-উপবনে আজ জড়ো হয়েছেন কিছু প্রকৃতি ও পরিবেশ সচেতন শিল্পী। নেটিভ আমেরিকানরা যে সমমনা ভিন্ন সংস্কৃতিকে তাঁদের প্ল্যাটফর্মে অন্তভুর্ক্ত করছেন, এ-বিষয়টি আমার ভালো লাগে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *