বিজ্ঞান ও দর্শনের দ্বন্দ্ব

গোলাম মোরশেদ খান

এটি নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, বিজ্ঞান তার মাতৃরূপী দর্শনের থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। প্রাথমিক যুগের দার্শনিকদের অন্তর্জ্ঞান বিজ্ঞানীদের মনোজগৎকে আলোকিত করেছে। আবার একই সঙ্গে বিজ্ঞানের ওপর দর্শন অনেক সময় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ারও জন্ম দিয়েছে, যখন প্রথাগত জ্ঞানের বাইরে নতুন চিন্তার কোনো অভিযাত্রায় তা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই একটি নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বিজ্ঞান ও দর্শনের মাঝে একটি সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব স্মরণাতীত কাল থেকেই চলে আসছে। কারো কারো ধারণা যে, বিজ্ঞানীরা অনেকটা শিকারি কুকুরের মতো, যারা সত্য নিরূপণ করতে মাটি শুঁকে শুঁকে প্রকৃতির নিয়মকে আবিষ্কার করে। অন্যদিকে দার্শনিকদের ভূমিকা হচ্ছে ঈগল পাখির মতো, যারা উঁচু আকাশে উড়তে উড়তেই সে বস্তুটির সন্ধান পায়।

পদার্থবিজ্ঞানীরা অবশ্য একটি কার্যকর দর্শন নিয়ে চলেন, সেটি হচ্ছে, বাস্তবতা নামক সত্যটিকে খুঁজে বের করা। এটি করতে গিয়ে তাঁদের পেরোতে হয় প্রত্যক্ষণ ও পরীক্ষণের জটিল কার্যক্রম। সেক্ষেত্রে দর্শনলব্ধ কোনো জ্ঞান ও ঐশীবাণী তাঁদের খুব কম ক্ষেত্রেই সাহায্য করে থাকে। অন্তত বর্তমান বিজ্ঞানীদের কোনো দিকনির্দেশনা দিতে দর্শন তার কার্যকারিতা হারিয়েছে – এ-কথাটি নির্দ্বিধায় বলা যায়। সম্ভবত দার্শনিকেরাও এ-সত্যটি সম্বন্ধে অবগত রয়েছেন। বিজ্ঞানের দর্শনে তাঁর তিন দশকের অভিজ্ঞতা থেকে দার্শনিক জর্জ গেইল বলেন যে, ‘আমাদের প্রাচীনগন্ধী আলোচনা ও বিতর্ক বর্তমান অতি অল্পসংখ্যক কর্মরত বিজ্ঞানীকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম।’ বিশ শতকের একজন গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ভিটগেনস্টাইন বলেছেন, ‘আমি নিশ্চিত যে কোনো বিজ্ঞানী কিংবা গণিতবিদ, যিনি আমার লেখা পড়বেন – তিনি আমার কাজ দিয়ে লক্ষযোগ্যভাবে প্রভাবিত হবেন না।’

পদার্থবিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়েনবার্গ নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন তাঁর ড্রিমস অব অ্যা ফাইনাল থিয়োরি নামক বইটিতে – ‘পদার্থবিদ্যা ও গণিতের উজ্জ্বল সাফল্যের বিপরীতে আমার পঠিত দর্শন গ্রন্থগুলো নিষ্প্রভ বলে মনে হয়েছে। এ সমস্ত গ্রন্থ এমনসব জটিল, দুর্বোধ্য বাক্য দিয়ে ভর্তি যে মাঝে মাঝে এগুলিকে অভেদ্য বলে মনে হয়েছে। আমি অবশ্য দু-একজন দার্শনিকের লেখা পড়ে উদ্দীপিত হয়েছি – যেমন ভিটগেনস্টাইন কিংবা পল ফেয়ারাব্যাল্ড। তবে তাদের সংখ্যা নগণ্য।’

এবার একটু অতীতের দিকে নজর ফেরানো যাক। ডেমোক্রিটাস ও লুসিপ্পাস চিন্তা করেছিলেন পরমাণুর কথা। মহাজগৎ পরিচালনার এমন একটি যান্ত্রিক ব্যাখ্যার কথা তাঁরা ভেবেছিলেন, যখন বাকি সবার বিশ্বাসের জগতে রাজত্ব করতো দৈত্য-দানো, দেবতা ও অন্যান্য অতিপ্রাকৃতিক শক্তি। এরপর এপিকিউরাসও অলিম্পিয়া পবর্তশীর্ষের মহাবলী দেবতাদের পরিবর্তে একটি যান্ত্রিক বিশ্বের ধারণা নিয়ে হাজির হলেন। সপ্তদশ শতকের ত্রিশের দশকে রেনে দেকার্তে যখন বিশ্ব পরিচালনার নিয়মগুলো বুঝে উঠতে একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা নিয়ে এলেন, তাঁর এই মতবাদ পরবর্তীকালে নিউটনের ওপর খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছিল। যান্ত্রিকতার এই দর্শন ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে চূড়ায় আরোহণ করে, যখন পদার্থবিদ্যা, গণিত, রসায়ন ইত্যাদি শাস্ত্রে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ঘটে। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, মানুষের চিন্তার ইতিহাসে এই যান্ত্রিক বিশ্বদৃষ্টি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্রে রয়েছে সূর্য, যে তার মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে গ্রহ-উপগ্রহগুলোকে ধরে রেখেছে – নিউটনের এই ব্যাখ্যাকে মেনে নিতে দেকার্তের অনুসারীদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। এর কারণ, তাঁরা কেউ বিশ্বাস করতে পারেননি যে, ৯ কোটি ৩০ লাখ মাইল দূর থেকে শূন্যস্থানের ভেতর দিয়ে একটি বস্তু কীভাবে অন্য বস্তুদের আকর্ষণ করবে! এ-বিষয় মেনে নিতে বিজ্ঞানীদের আরো প্রায় দু-শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়েছে। যেসব ইউরোপীয় দেশের বিজ্ঞানীরা একে মেনে নেন, ক্রমানুসারে সেগুলি হচ্ছে – ব্রিটেন, হল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স ও জার্মানি। তবে এই পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছেন ফরাসি লেখক ভলতেয়ার ও জার্মান দার্শনিক কান্ট। এরপর ঊনবিংশ শতকে যান্ত্রিকতার দর্শন আরো প্রসার লাভ করে মাইকেল ফ্যারাডে, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল প্রমুখের কর্মকাণ্ডে।

এরপর ১৯০০ সালে ম্যাক্স প্লাঙ্ক কর্তৃক কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন কর্তৃক আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আবিষ্কার হওয়ার পর ঘটলো একটি চূড়ান্ত মোড় পরিবর্তন। তবে এরপরও পুরনো ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী বিজ্ঞানীদের মধ্যে চিরায়ত বিজ্ঞানের দর্শন বেশ প্রভাব বজায় রেখেই চললো। এ-ঘটনাটি নিয়েই রাসেল ম্যাককরমাক তাঁর Night Thoughts of a Classical Physicis বইটিতে একটি কাল্পনিক চরিত্র – অধ্যাপক ভিক্টর জ্যাকবকে তুলে ধরেছেন, যিনি নতুন বিজ্ঞানের এ-দর্শনকে মেনে নিতে পারছিলেন না।

ঊনবিংশ শতকের সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক মার্কস ও এঙ্গেলসের অনুসারীরাও বিশ শতকের প্রথমদিকে বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা নিয়ে গুরুতর সমস্যায় পড়েন। লেনিন রাশিয়ার ক্ষমতা দখল করার আগেই, ১৯০৮ সালে, একটি শব্দাড়ম্বরপূর্ণ বই লেখেন, Materialism and of Empirio-criticism নামে, যার দর্শন আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাকে সোভিয়েত বিপ্লব-পরবর্তী রাশিয়াতে গ্রহণ করে নিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি রুশ বিপ্লবের চার দশক পরও ১৯৬১ সালে প্রখ্যাত সোভিয়েত পদার্থবিদ ভøাদিমির ফক তাঁর বই The Theory of Space, Time and Gravitation-এর ভূমিকাতে লিখেছিলেন – ‘স্থান, কাল ও মহাকর্ষ নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনা রূপ লাভ করেছে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ থেকে – বিশেষ করে লেনিনের লেখা মেটেরিয়েলিজম অ্যান্ড ইম্পেরিও ক্রিটিসিজম বইটি থেকে।’

বিশ শতকের প্রথম দিকেই প্লাঙ্ক-আইনস্টাইন-বোহরের অভিভাবকত্বে ‘কোয়ান্টাম ও আপেক্ষিকতার যুগ’ শুরু হওয়ার পর থেকেই চিরায়ত পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রটি সংকুচিত হয়ে আসতে থাকে। পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে আবির্ভূত হলো বস্তু ও প্রতিবস্তু কণিকা ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন, পজিট্রন এবং অন্যদিকে বিভিন্ন বলক্ষেত্র – বিদ্যুৎ ও চুম্বকীয় ক্ষেত্র, মহাকর্ষীয় বলের ক্ষেত্র ইত্যাদি – যেসব বলক্ষেত্র নানা বস্তুকণিকারই সৃষ্টি। এরপর ১৯২৯ সালে পদার্থবিদ্যা আরো একটি একীভূত দৃষ্টিভঙ্গির দিকে এগুলো – যখন হাইজেনবার্গ এবং পাউলি কণিকা ও বলকে ব্যাখ্যা করলেন বাস্তবতার আরো এক গভীর স্তর – কোয়ান্টাম ক্ষেত্রে। এর আগেই কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে প্রয়োগ করা হয়েছে আইনস্টাইনের আলোককণিকা, ‘ফোটনে’র বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্রে। এখন পাউলি ও হাইজেনবার্গ দেখলেন যে, শুধু ফোটন নয়, সব বস্তুকণিকাই বলক্ষেত্রে একটি শক্তি – যেমন ইলেকট্রন হচ্ছে ইলেকট্রন ক্ষেত্রের শক্তি, নিউট্রিনো হচ্ছে নিউট্রিনো ক্ষেত্রের শক্তি ইত্যাদি। কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্ব (Quantum Field Theory) ১৯৫০-এর দশকে বিশ্বব্যাপী একটি স্বীকৃত তত্ত্ব হিসেবে গৃহীত হয় এবং মৌলিক পদার্থবিদ্যার একটি কাঠামো হয়ে দাঁড়ায়। এরপর থেকে পদার্থবিদরা বিশ্বসংসারের উপাদান হিসেবে দেখতে পান বস্তুকণা নয়, শুধু কিছু বল-ক্ষেত্রকে।

এরপর থেকে পুরনো যান্ত্রিক ব্যাখ্যার বিশ্বদৃষ্টি আর পুনর্জীবিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা গেল না। কিন্তু এই কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্বও চূড়ান্ত কিছু নয়, কারণ এতে মহাকর্ষ বলকে অন্তর্ভুক্ত করতে সমস্যা রয়ে গেল। এক্ষেত্রে পরবর্তীকালে এলো স্ট্রিং তত্ত্ব। কান্ট আমাদের শিখিয়েছিলেন যে, স্থান ও কাল বহির্জগতের কোনো বাস্তবতা নয়, বরং  তা আমাদের আন্তর্জগতেরই পূর্বরচিত কাঠামো, যা আমাদের বস্তু ও ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করে। কিন্তু কান্ট-শিষ্যদের কাছে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা আসে একটি আঘাত হিসেবে, যাতে স্থান ও কাল নির্ভর করে গতি এবং মহাকর্ষের ওপর। তবে আপেক্ষিকতা তত্ত্বের শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়ার পরও কিছু পদার্থবিদ মনে করেন যে, স্থান ও কাল নির্ভর করে বিশুদ্ধ চিন্তার ওপর।

মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে এরকম একটি ‘অধিবিদ্যাগত সমস্যা’ তৈরি হয় যখন বিগ ব্যাংগ তত্ত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয় যে, তাহলে এর আগে কী ছিল? এর উত্তর দিতে গিয়ে পদার্থবিদরা বলেন যে, এর আগে বলে কিছু হয় না – যেমনটা চূড়ান্ত শীতল তাপমাত্রার (-২৭৩°k) নিচে কোনো তাপমাত্রা নামতে পারে না কিংবা উত্তর মেরুর উত্তরে কিছু হয় না। সেন্ট অগাস্টিন তাঁর ঈড়হভবংংরড়হ বইটিতে এ-প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা করেছেন – বিশ্ব সৃষ্টির আগে ঈশ্বর কী করছিলেন, তা প্রশ্ন করা অর্থহীন। কারণ ঈশ্বর ছিলেন সময়ের বাইরে এবং তিনি একই সঙ্গে সময় ও মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন।

আধুনিক পদার্থবিদ্যার কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় ভূমিকা রেখেছে যে দর্শন, তার নাম প্রত্যক্ষবাদ (Confession)। পদার্থবিদ্যায় এই প্রত্যক্ষবাদের অনুপ্রবেশ আর্নেস্ট মাখের হাত ধরে, যিনি নিজে ভিয়েনার একজন পদার্থবিদ ও দার্শনিক। তিনি অবশ্য কান্টের অধিবিদ্যাকে নস্যাৎ করতেই প্রত্যক্ষবাদকে ব্যবহার করেছিলেন। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতার সূত্রে (১৯০৫) মাখের প্রভাব অনস্বীকার্য। প্রত্যক্ষবাদই আইনস্টাইনকে এ-ধারণা দিতে প্রভাবিত করে যে, দুটি ঘটনাকে একজন দর্শক যেমন একইভাবে দেখবে না, তেমনি একটি ঘটনাকে দুজন দর্শকও একইভাবে দেখবে না। অবশ্য মাখের কাছে চিঠিতে আইনস্টাইন তাঁর ঋণ স্বীকার করেছেন – মাখের রচিত পুস্তক অনুভূতিসমূহের বিশ্লেষণ তাঁর প্রিয় বইগুলির একটি। মাখের কাছে লেখা একটি চিঠিতে আইনস্টাইন তাঁর নিজের নাম স্বাক্ষর করেছেন ‘আপনার অনুগত ছাত্র’ বলে। তবে প্রথম মহাযুদ্ধের পর ভিয়েনা সার্কেলের দার্শনিকরা, বিশেষত রুডলফ কারনাপ প্রত্যক্ষবাদকে অধিবিদ্যাগত আবর্জনা থেকে অনেকটা মুক্ত করেন।

১৯২৫ সালে হাইজেনবার্গের বিখ্যাত অনিশ্চয়তা তত্ত্ব, যা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সম্ভাব্যতার ধারণাকে ভিত্তি দিয়েছে, তা প্রত্যক্ষবাদের প্রভাবেই প্রাপ্ত। আইনস্টাইন ও হাইজেনবার্গের কাছে মূল্য থাকা সত্ত্বেও প্রত্যক্ষবাদ যথেষ্ট ক্ষতিও করেছে। তবে যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে প্রত্যক্ষবাদ তার বীরোচিত উজ্জ্বল মশাল অব্যাহত রেখেছে। জর্জ গেইল অবশ্য প্রত্যক্ষবাদকে দোষী করেছেন পদার্থবিদ ও দার্শনিকদের বর্তমান বিচ্ছেদের জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *