বিদ্যাসাগর অমৃতকথা

সেলিম মাহমুদ

মাতৃভক্তি, শিশুদের পাঠ্যবই রচনা, দানশীলতা, বিধবা বিবাহ প্রচলন প্রভৃতি কর্মসম্পাদন দ্বারা বাঙালির মনের মণিকোঠায় বিদ্যাসাগর অবিস্মরণীয় এক সত্তা। বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে যেসব গুণপনা বহুচর্চিত,  সেগুলি হচ্ছে – বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যরীতির জনক, সমাজ-সংস্কারক, স্ত্রীশিক্ষার প্রবর্তক, সৃষ্টিশীল অনুবাদক ইত্যাদি।

বাংলার শিক্ষা ও সমাজের ইতিহাসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উন্মুক্ত ও উদার মননের প্রতীক। তাঁর বিদ্যা ও দয়া কোনোটাই ভোলার নয়।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক বক্তৃতামালায় বক্তৃতা শুরু করেছিলেন বিদ্যাসাগরের চরিত্রের অন্যতম প্রধান গুণের কথা বলে – ‘যে গুণে তিনি পল্লী আচারের ক্ষুদ্রতা, বাঙালি জীবনের জড়ত্ব সবলে ভেদ করিয়া একমাত্র নিজের গতিবেদপ্রাবল্যে কঠিন প্রতিকূলতায় বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া – হিন্দুত্বের দিকে নহে – করুণার অশ্রজলপূর্ণ উন্মুক্ত অপার মনুষ্যত্বের অভিমুখে আপনার দৃঢ়নিষ্ঠ একাগ্র একক জীবনকে প্রবাহিত করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন।’

রবীন্দ্রনাথের কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমাদের আলোচনার বিদ্যাসাগরের ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য গ্রন্থে প্রাবন্ধিক-গবেষক রাজীব সরকার লিখেছেন, ‘সংস্কৃতের ব্যাকরণ, সাহিত্য, স্মৃতিতে অসাধারণ পারদর্শিতার জন্য সংস্কৃত কলেজ কর্তৃক ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিতে ভূষিত হয়েও তিনি আচরণে ‘ব্রাহ্মণত্ব’ অর্জন করলেন না।’ অন্য এক জায়গায় রাজীব সরকার বলেছেন,  ‘উনিশ শতকের ভারতবর্ষে ইহজাগতিকতার লক্ষণ সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যায় বিদ্যাসাগরের চরিত্রে। সেই যুগের আদর্শ ‘হিউম্যানিস্ট’ বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরের কাছে হিউম্যানিজম কথাটির অর্থ মানবমুখিনতা। এটিই তাঁর ইহজাগতিকতার স্বরূপ।’ (‘বিদ্যাসাগরের ইহজাগতিকতা’, পৃ ১২)

বিদ্যাসাগরচর্চা গ্রন্থে অভ্র ঘোষ ‘প্রসঙ্গ কথা’ অংশে লিখেছেন, ‘উনিশ শতকের বাংলাদেশে বিদ্যাসাগর একক ব্যক্তিত্ব যিনি ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাননি। …। যুক্তি-বুদ্ধি-কাণ্ডজ্ঞান ছিল বিদ্যাসাগরের সমস্ত চিন্তা ও কর্মের আয়ুধ। …। বিদ্যাসাগর-এর শিক্ষাচিন্তা, সমাজ সংস্কারের চিন্তায় পাশ্চাত্যের কমন সেন্সের দর্শন, যুক্তিশীলতা ও প্রাচ্যের দর্শন ও শাস্ত্রের এক সার্থক সমন্বয় ঘটেছিল।’ তাঁর এই উক্তি আলোচ্য গ্রন্থের মূলভাবের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নিঃসন্দেহে।

রাজীব সরকারের বিদ্যাসাগরের ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য গ্রন্থের ‘বিদ্যাসাগরের ইহজাগতিকতা’, ‘সমকালীনদের চোখে বিদ্যাসাগর’, ‘বিদ্যাসাগর : নিঃসঙ্গ প্রমিথিউস’, ‘রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর’ ইত্যাদি প্রবেন্ধ দর্শন, যুক্তিশীলতা, মানবমুখিনতা, রেনেসাঁস – এসব দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করা হয়েছে যুক্তিনিষ্ঠ ও সহজ-সাবলীল ভাষায়।

বাঙালি শিক্ষার্থীর সবার পরিচিত বর্ণ পরিচয়  নিয়ে রাজীব সরকার তাঁর বক্তব্যের মূলভাব প্রকাশ করেছেন – ‘‘বর্ণ পরিচয়’ বইয়ে তিনি রাখাল বা গোপালের কোনো পদবি দেননি। বলেননি, মিথ্যা কথা বলা পাপ। বললেন, মিথ্যা কথা বলা বড় দোষ।’ (‘বিদ্যাসাগরের ইহজাগতিকতা’, পৃ ১৭)

এমন সরল, অকপট, যুক্তিগ্রাহ্য উপস্থাপনে বিদ্যাসাগরের ইহজাগতিকতা প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে লেখকের উদ্ধৃতি – ‘বিদ্যাসাগর উনবিংশ শতাব্দীতে ধর্মনিরপেক্ষ বস্তুবাদী জীবনদর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানসম্মত জীবনসাধনার সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতীক।’

ইহজাগতিকতার আলোকে বিদ্যাসাগরের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যকে যুক্তিবাদী ও নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে অবলোকন ও বিশ্লেষণ করেছেন গ্রন্থকার রাজীব সরকার। শুধু বিদ্যাসাগর নন, তাঁর আদর্শের অনুসারী জ্ঞানালোকে আলোকিত অন্যান্য কীর্তিমান বাঙালি সম্পর্কেও আলোকপাত রয়েছে গ্রন্থটিতে। যেমন – ‘বুদ্ধদের বসুর ‘কবিতা’ ও ‘রবীন্দ্রসংখ্যা’, ‘নজরুলের দুটি বিশেষ ভূমিকা’, ‘নজরুলের প্রবন্ধসাহিত্য’, ‘নজরুল ও বাঙালির সমন্বয়বাদী ঐতিহ্য’, ‘নজরুল চেতনায় দুর্গোৎসব’, ‘যতীন সরকারের নজরুল অবলোকন’, ‘অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাঙালিত্ব সাধনা’, ‘ইহজাগতিকতার সংকট ও আনিসুজ্জামান’, ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় : বাঙালি সংস্কৃতির সব্যসাচী’।

উনিশ শতকের রেনেসাঁস ও ইয়ং বেঙ্গল, প্যারীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ সিকদার, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, হরচন্দ্র ঘোষ, শিবচন্দ্র দেব, রামতনু লাহিড়ীর উল্লেখ-প্রসঙ্গ  ও ভূমিকাও রাজীব সরকারের মূল্যায়নে এসেছে।

অন্য এক আলোকপাতে রাজীব সরকার বলেছেন  – ‘বাংলার নবজাগরণের প্রত্যক্ষ ফসল হিসেবে গদ্যে যে ভূমিকা পালন করেছেন বিদ্যাসাগর পদ্যে সেই ভূমিকা পালন করেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মাইকেলের প্রায় অর্ধশতাব্দীর জীবনে বিদ্যাসাগরের চেয়ে বড় কোন শুভাকাক্সক্ষী ছিলেন না।’ (‘সমকালীনদের চোখে বিদ্যাসাগর’, পৃ ২৮)

বিদ্যাসাগর নিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মূল্যায়ন – ‘প্রাচীন ঋষিদের মতো প্রতিভা ও জ্ঞান, ইংরেজদের মতো প্রাণশক্তি আর বাঙালি মায়ের হৃদয়।’

বিদ্যাসাগর নিয়ে রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি এবং সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতামত প্রণিধানযোগ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *