গ্রাসিয়া ডেলেড্ডা
ভাষান্তর : ওয়াহিদা নূর আফজা
গ্রাসিয়া ডেলেড্ডার জন্ম ১৮৭১ সালে ২৭শে সেপ্টেম্বর ইতালির সার্ডিনিয়ার নুওরোতে। তাঁর মৃত্যু ১৯৩৬ সালের ১৫ই রোমে।
ডেলেড্ডার জন্ম এক সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবারে। তাঁর বাড়ির বৈঠকখানায় বসতো গল্পের আসর। কিশোরী গ্রাসিয়া উৎসাহ নিয়ে তা শুনতেন। সে-সময়ের ইতালির নিয়মানুযায়ী মেয়ে হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পেয়েছিলেন চার বছরের। বাড়িতে গৃহশিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় মাত্র ১৩ বছর বয়সে পত্রিকায় প্রথম লেখা পাঠান। সহমর্মিতা এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টি তাঁকে পারিপার্শ্বিক সামাজিক পরিবেশ এবং মানুষের অনুভূতি বুঝতে সাহায্য করেছে।
ডেলেড্ডা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান ১৯২৬ সালে। ‘Mentre soffia il levante’ গল্পটি ১৯০৫ সালের দিকে লেখা। এটি পরে ইংরেজিতে ‘While the East Wind
Blows’ নামে অনুবাদ করেন অ্যান্ডার্স হ্যালেনগ্রেন।
প্রাচীন এক সার্ডিনিয়ান কিংবদন্তি অনুসারে, যারা বড়দিনের আগের দিন জন্মেছে, তাদের দেহ ধুলোয় মিশে যাবে না, বরং সময়ের শেষ পর্যন্ত অক্ষত থাকবে।
এমন বিষয় নিয়ে কথা বলাটা দিদ্দিনু ফ্রাউর বাড়িতে স্বাভাবিক একটি বিষয় ছিল। দিদ্দিনুকে সবাই চাচা বলে ডাকত। তবে এ কথায় আপত্তি জানালো তাঁর মেয়ের প্রেমিক প্রেদু তাসকা।
সে বলল, ‘কিন্তু কোন উদ্দেশ্যে? মরে গেলে এ-শরীরের আর কী প্রয়োজন আছে?’
‘হুম’, দিদ্দিনু বললেন, ‘শেষ বিচারের দিন ভাঙাচোরা অবস্থার থেকে একেবারে অক্ষত দেহে থাকতে পারাটা কী বেশি সম্মানের নয়?’
প্রেদুর ছিল তারুণ্যের অহংকার। দিদ্দিনুর কথাকে অতো আমল দেবে কেন সে? প্রেদু বলল, ‘এটি কী সত্যিই তেমন বড় কিছু?’
‘জামাই, চলো আমরা এই বিষয় নিয়ে একটা কবিগানের আসর বসাই।’
দিদ্দিনু একজন বেশ ভালো কবিয়াল। বংশানুক্রমিকভাবে বাপ-দাদার আমল থেকে এই পরিবারে কবিয়ালের প্রতিভা বইছে। প্রতিভা সবসময় প্রকাশের সুযোগ খোঁজে। তাই দিদ্দিনু একটা অজুহাত পেলেই কবিগানের আসর বসাতে চান। বিশেষ করে যখন দেখেন যে আশপাশে তাঁর থেকে আর তেমন ভালো কবিয়াল নেই।
মারিয়া ফ্রান্জিসকা এতোক্ষণ চুপ করে সব দেখছিল। এবার তার হবু বরের পক্ষে বলল, ‘এরকম একটা মন খারাপ-করা-বিষয় নিয়ে গান না করলে হয় না?’
‘তুমি এখানে কী করছ? যাও ভেতরে যাও।’ মারিয়ার বাবার কণ্ঠস্বর যথেষ্টই রুক্ষ ছিল।
একজন কবিয়াল হলেও দিদ্দিনু ছিল বুনো স্বভাবের, পরিবারে, বিশেষ করে তাঁর মেয়েদের সঙ্গে তাঁর আচরণ ছিল দয়ামায়াহীন। তাঁর পরিবার তাঁকে সম্মান করত, কিন্তু সবাই তাঁকে ভয়ও পেত। বাবার সামনে বাবার সামনে মারিয়া ফ্রান্জিসকা তার প্রিয় প্রেদুর কাছ ঘেঁষে বসার সাহসই করত না। একটা সামাজিক রীতি অনুযায়ী বাগদান হয়েছে এমন প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে কিছুটা দূরত্ব যেহেতু রাখতে হয় মারিয়া তাই একটু দূরেই বসেছিল। তবে নানা কামনাজাগানিয়া দেহভঙ্গিমায় সে প্রেদুকে আকর্ষণ করে যাচ্ছিল। মারিয়ার সবুজাভ-নীল কাঠবাদামের মতো চোখ ছিল মোহবিস্তারী। সেইসঙ্গে ছিল ফুলের কাজ করা গাঢ় লাল লেস-শোভিত কটি। তার মুখ সে ঢেকে রেখেছিল লেসের ঘোমটায়, নিজেকে প্রেদুর কাছে আরো রহস্যময়ী করে তোলার জন্য।
সময়টা ছিল বড়দিনের আগের সন্ধ্যাবেলা। বয়ে যাচ্ছিল মৃদুমন্দ পূবালী হাওয়া। সেই বাতাসে যেন মিশে ছিল একই সঙ্গে মরুভূমির উষ্ণতা আর সাগরের আর্দ্রতা।
উপত্যকার কাজুবাদামের গাছগুলি পূবালী হাওয়ায় ক্রমাগত দুলছে। তার থেকে খসে পড়ছিল আধফোটা কলির কিছু সাদা পাপড়ি। সেসব আবার দূরের পাহাড়ের সবুজ ঢালে ভেসে বেড়ান কুয়াশার মধ্যে মিশে এমন এক সুপ্ত আগুন কুণ্ডুলীর আবহ তৈরি করছিল যার ধোঁয়া তখনো দেখা যায়নি, কিন্তু উষ্ণতা অনুভব করা যাচ্ছিল। পাহাড়ের মাথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে মেঘেদের মেলা। তারা যেন পাখা মেলে দিয়েছিল আকাশ জুড়ে। ঠিক যেন সেই অদৃশ্য আগুনের ধোঁয়া।
শহরে তখন ভোজের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। লেভেন্টাইন বাতাসের মতো মানুষ জড়ো হচ্ছিল পথে-পথে, বাড়িতে-বাড়িতে – খ্রিষ্টের জন্মতিথি উদ্যাপনের উদ্দেশ্যে। পরিবারগুলির মধ্যে উপহারবিনিময় শুরু হয়ে গেছে। তারা পানাহারে মেতে উঠেছে শূকর ভাজা, ভেড়ার মাংস, মিষ্টি, কেক আর শুকনো ফলের সমাহারে। গোয়ালারা নিয়ে এসেছে তাদের গাভীর প্রথম দুধ। একটা প্রবাদ আছে, খালি পাত্র আদান-প্রদানে গাভীদের অমঙ্গল হয়। তাই গৃহিণীরা দুধ ঢেলে সেসব খালি পাত্র শাকসবজি বা অন্যকিছু দিয়ে ভরে দিচ্ছে।
প্রেদু তাসকারের ছিল একপাল শূকর। রীতি অনুযায়ী সে তার সবচেয়ে ভালো শূকরটি জবাই করে একটি ঝুড়িতে ভরেছে। তারপর সেই ঝুড়িটি আবার শূকরের রক্ত দিয়ে রঞ্জিত করে লিলি ফুল দিয়ে সাজিয়ে তার বাগদত্তাকে ভেট হিসেবে পাঠিয়েছে। বিনিময়ে মারিয়া সে-ঝুড়ি ফেরত পাঠিয়েছিল মধু আর বাদামের কেক বানিয়ে। সেইসঙ্গে যে-মহিলা এই ঝুড়িটি নিয়ে এসেছিল তাকে পারিতোষিক হিসেবে দিয়েছে পাঁচ লিরা মূল্যমানের রৌপ্যমুদ্রা।
সন্ধ্যার দিকে ফ্রাউর বাড়িতে এসে প্রেদু মারিয়ার হাত নিজের প্রশস্ত হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলো। একঝলক বিদ্যুৎ তরঙ্গ যেন আবিষ্ট করল মারিয়াকে। সে শিহরিত হলো, আবার লজ্জাও পেল। খুব দ্রুত প্রেদুর হাতের বন্ধন থেকে নিজের হাত দুটো ছাড়িয়ে নিল মারিয়া। তারপরও সেই অবশ-করা স্পর্শ তাকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখলো। এখানেই শেষ নয়, তার জন্য আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। প্রেদু ইতোমধ্যে তার হাতে একটি স্বর্ণমুদ্রা গুঁজে দিয়েছে। এরপর মারিয়া সেখানে আর থাকেনি। সে ব্যস্ত হয়ে উঠলো অন্দরমহলের সবাইকে তার সদ্য পাওয়া উপহারটি দেখাতে।