শামসুর রাহমানের কাব্যসমালোচনার অনন্য ধরন : চল্লিশের দুজন কবি

সৌভিক রেজা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পথের সঞ্চয় গ্রন্থে বলেছিলেন, ‘কবি যেখানে প্রত্যক্ষ অনুভূতি হইতে কাব্য লেখেন সেখানে তাঁহার লেখা গাছের ফুল-ফলের মতো আপনি সম্পূর্ণ হইয়া বিকাশ পায়।’ এরই রেশ টেনে তিনি আরো জানিয়েছিলেন, এই বিকশিত কাব্য ‘আপনাকে ব্যাখ্যা করে না অথবা নিজেকে মনোরম বা হৃদয়ঙ্গম করিয়া তুলিবার জন্য সে নিজের প্রতি কোনো জবরদস্তি করিতে পারে না।’ তাহলে সে কী করে? – এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ আমাদের জানিয়েছেন, ‘সে যাহা সে তাহা হইয়াই দেখা দেয়; তাহাকে গ্রহণ করা, তাহাকে ভোগ করা পাঠকেরই গরজ।’ রবীন্দ্রনাথের কথাকে মান্যতা দিয়েই আমরা বলতে পারি, এই গরজটা শুধুই পাঠকের একার নয়, সেটি একজন সাহিত্য-সমালোচকেরও গরজ। কেন এই গরজ? তার উত্তর দিতে গিয়ে আমরা আবারো রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করতে পারি। কেননা, তিনি বিশ^াস করতেন যে, ‘সাহিত্যকে যে ঠিকভাবে দেখে সে মেপে দেখে না, তলিয়ে দেখে।’ একজন সমালোচকের প্রধান কাজই হচ্ছে, এই তলিয়ে দেখাটা নিরন্তর চেষ্টা করে যাওয়া। আর সে-কারণেই কবি শামসুর রাহমানের প্রসঙ্গ বারবার প্রাসঙ্গিকভাবেই উঠে আসে। কেননা, তিনি এমন একজন ব্যক্তি, যিনি, আরো অল্প কিছু কবির মতোই, সাহিত্যকে আজীবন তলিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন।

দুই

আমরা এইটা জানি যে, শামসুর রাহমান কবিতা রচনাতে যতটা আনন্দ পেতেন, অন্য কোনো কিছুতেই ততটা অনুভব করতেন না। নিজের এই প্রবণতা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘অন্য যে-কোনো ব্যাপারে আলস্য আমাকে যত বেশী দখল করুক, কবিতা রচনায় আমি এখনো অনলস। সিদ্ধি নিয়ে মাথা ঘামাই না, তা বিচারের ভার পাঠক, বোদ্ধা ও সহৃদয় সমালোচকের ওপর ছেড়ে দিয়ে স্বস্তিবোধ করতে চাই। কবিতা লেখাতেই আমার আনন্দ।’ নিজের সাহিত্যিক উপলব্ধি বিষয়ে তিনি আমাদের আরো জানিয়েছিলেন, ‘যখন সাহিত্যচর্চায় হাতে-খড়ি হয় তখন আমরা নিজেদের রবীন্দ্রস্বর্গ থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত করেছিলাম। এ স্বেচ্ছা-নির্বাসনের পেছনে অবশ্য ছিলো তিরিশের সেই প্রধান পুরুষদের তুমুল আন্দোলনের প্ররোচনা ও কতিপয় বিদেশী ঠাকুরের মহিমার মন্ত্রণা।’ শুধুই তাঁর কবিতার আলোচনায় নয়, তাঁর সমালোচনাকর্ম নিয়ে আলোচনা করতে গেলেও এই বিষয়টি আমাদের স্মরণে রাখা জরুরি। আর সে-কারণেই, আমরা চল্লিশের দুজন প্রতিনিধি-স্থানীয় কবির কাব্যকর্ম নিয়ে, শামসুর রাহমানের তলিয়ে দেখাটা, এখানে খানিকটা পর্যালোচনা করতে চাইছি।

তিন

প্রথমেই সমর সেনের প্রসঙ্গে আসা যেতে পারে। সেদিনের তরুণ কবি সমর সেনের কবিতায় বুদ্ধদেব বসু দেখতে পেয়েছিলেন কাব্য-বিদ্রোহের এক অনন্য ‘ভাব ও ভঙ্গি’। ভঙ্গির কথা বলতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসু জানিয়েছিলেন, ‘তাঁর [সমর সেন] কবিতা গদ্যে রচিত, এবং কেবলই গদ্যে।’ এ-বিষয়ে তাঁর নিজের ধারণা যে ‘ভুল’ ছিল, সেটি স্বীকার করেই বুদ্ধদেব জানান, ‘আমার ধারণা ছিলো পদ্যরচনায় ভালো দখল থাকলে তবেই গদ্যকবিতায় স্বাচ্ছন্দ্য আসে, কিন্তু সমর সেনের মধ্যে এর ব্যতিক্রম দেখলুম।’ এ-বিষয়ে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘তিনি গদ্যে ছাড়া লেখেননি, এবং কখনো লিখবেন এমন আশাও আমার নেই।’ বুদ্ধদেব তাঁর সেই একই প্রবন্ধে সমর সেনের গদ্যছন্দ সম্পর্কে পাঠকদের জানিয়েছিলেন, ‘এখানে এটা বিশেষ করে উল্লেখ্য যে তাঁর গদ্যছন্দ বাংলা ভাষায় অভিনব, রবীন্দ্রনাথ বা অন্য কোনো কবির ছাঁচে ঢালাই করা নয়।’ অন্যদিকে, বুদ্ধদেব বসুর গদ্য-রচনা সম্পর্কে শামসুর রাহমান বলছেন, ‘বুদ্ধদেব বসু আমার প্রিয়তম লেখকদের অন্যতম, তাঁর যে কোনও লেখা সুখপাঠ্য; কখনও লগি ঠেলতে হয় না, ছিপছিপে নৌকোর মতো তরতরিয়ে  এগিয়ে যায়। … বুদ্ধদেবের যে কোনও গদ্যরচনা আমি তারিয়ে তারিয়ে চাখতে পছন্দ করি। ‘কালের পুতুলে’র বেলাতেও এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি।’ শামসুর রাহমান কালের পুতুলের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেই আমাদের জানান যে, ‘এই ‘কালের পুতুল’ গ্রন্থটিতেই আমি সর্বপ্রথম সমর সেনের কবিতা বিষয়ে আলোচনা পড়ি, তাঁর কবিতা না পড়ার আগেই।’ আর সেই প্রসঙ্গ ধরেই তিনি বলেছিলেন, ‘সৌভাগ্যক্রমে অল্পদিনের মধ্যেই সমর সেনের প্রথম কবিতার বই ‘কয়েকটি কবিতা’ সংগ্রহ করতে পারলাম একটি পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে। চটি বই, একরঙা মলাট। … বইটি দেখতে আদৌ এখনকার অধিকাংশ বইয়ের মতো চিত্তহারী নয়। কিন্তু সেই অনাকর্ষণীয়, অনুজ্জ্বল মলাটের আড়ালে নবীন পাঠকের জন্য অপেক্ষা করছিল কবিতার জ্বলজ্বলে পঙ্ক্তিমালা।’ সমর সেনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ কয়েকটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৭ সালের মার্চ মাসে। গ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেন প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদকে। শামসুর রাহমান যে ‘জ্বলজ্বলে পঙ্ক্তিমালা’র কথা উল্লেখ করেছিলেন, সেটি এই কাব্যের সর্বত্রই আমরা দেখতে পাই –

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *