সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান
কিছু মানুষ পৃথিবীর বুকে আসে সুন্দর একটি পৃথিবী গড়ার আকাশচুম্বী স্বপ্ন নিয়ে। তারা ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থা বদলে দিতে নিজেকে উজাড় করে নিরন্তর সংগ্রাম করে যায়। নিঃস্বার্থভাবে মুক্তি ও মানবতার বার্তা ফেরি করে পথে-প্রান্তরে। অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হয়ে রুখে দাঁড়ায়। তাঁদেরই একজন হলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় দলছুট ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী সঞ্জীব চৌধুরী। তিনি ছিলেন একাধারে একজন খ্যাতিমান গায়ক, গীতিকার, সুরকার, নাট্যাভিনেতা, সাংবাদিক ও কবি। এর বাইরেও তিনি বহুগুণে গুণান্বিত, আরো বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন। সবকিছুর মধ্যে তাঁর অন্যতম গুণ হচ্ছে, তিনি ছিলেন বিপ্লবী ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন একজন মানুষ। কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি, বরং মাথা তুলে বুক চিতিয়ে উচ্চৈঃস্বরে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন। তাঁকে দেখতে যতটাই গম্ভীর মনে হতো না কেন, তিনি ছিলেন অত্যন্ত রসবোধসম্পন্ন একজন হাস্যোজ্জ্বল মানুষ। তিনি এতটাই রসিক ছিলেন যে, নিজের মৃত্যু নিয়েও কাছের মানুষদের সঙ্গে রসিকতা করতে দ্বিধাবোধ করেননি। নিশ্চিত মৃত্যু বুঝতে পেরেও তিনি তা নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত ছিলেন না। সত্যি কথা বলতে, প্রকৃত অর্থে যাঁরা বিপ্লবী, তাঁদের এমন স্বভাবের হতেই দেখা যায়। তাঁরা জানেন, বিপ্লবীদের কখনো মৃত্যু হয় না। বিপ্লবীরা ফিনিক্স পাখির মতো বারবার জন্ম নিয়ে পৃথিবীর বুকে ফিরে আসে। তিনি সেই বিশ্বাস থেকেই হয়তো বলেছিলেন, ‘টিএসসি চত্বরে কিংবা আজিজ সুপার মার্কেটে আমি থাকবো না, সেটা কী কখনো কল্পনা করা যায়! গিয়ে দেখবেন, আমি সেখানে মস্ত আড্ডা জমিয়ে বসে আছি। জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতাটির আদলে আমি আউড়ে যাই, আবার আসিব ফিরে, টিএসসির মোড়ে, হয়তো কোনো এক বিপ্লবীর বেশে।’ সঞ্জীব চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁর সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনের চত্বরের নামকরণ করা হয় ‘সঞ্জীব চত্বর’। যদিও তিনি ছিলেন একজন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী কিন্তু তাঁর ধ্যানে-জ্ঞানে ছিল বিপ্লব। তাই তিনি গানটাকেই করেছিলেন প্রতিবাদের হাতিয়ার। ছাত্রজীবনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গেই সম্পৃক্ত ছিলেন। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে মিছিলে প্রতিবাদী গান গেয়ে আন্দোলন চাঙ্গা করে রাখতেন। বন্দুকের নলের মুখে দাঁড়িয়েও তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হয়ে বুক চিতিয়ে প্রতিবাদের গান গাইতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। তাঁর প্রতিবাদের ধরন তরুণ প্রজন্মকে ব্যাপকভাবে উজ্জীবিত করে। তাই সঞ্জীব চৌধুরীকে প্রজন্মের কণ্ঠস্বর হিসেবেও অভিহিত করা হয়।
১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে একটি সম্ভ্রান্ত হিন্দু জমিদার পরিবারে সঞ্জীব চৌধুরীর জন্ম। তাঁর পিতার নাম গোপাল চৌধুরী এবং মাতার নাম প্রভাষিণী চৌধুরী। তিনি তাঁর পিতামাতার নয় সন্তানের মধ্যে ছিলেন সপ্তম। তবে তাঁদের মূল বাড়ি সিলেট জেলার বিশ্বনাথ থানার দশঘর গ্রামে। সেখানকার জমিদার শরৎ রায় চৌধুরী ছিলেন তাঁর পিতামহ। ছাত্রজীবনে তিনি বেশ মেধাবী ছিলেন। ছোটবেলায় হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন ও এরপরে ঢাকার বকশী বাজার নবকুমার ইনস্টিটিউটে নবম শ্রেণিতে এসে ভর্তি হন। এখান থেকে ১৯৭৮ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ১২তম স্থান অর্জন করেন। ১৯৮০ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও মেধা তালিকায় স্থান করে নেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে ভর্তি হন; কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা শেষ না করে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। সাংবাদিকতায় পড়ার দরুন পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে গ্রহণ করেন। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করে আশির দশকের শুরুর দিকে তিনি পেশাগতভাবে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হন। প্রথমেই দৈনিক উত্তরণে কাজ করা শুরু করেন তিনি। এরপর ভোরের কাগজ, আজকের কাগজ, যায়যায়দিন প্রভৃতি দৈনিক পত্রিকায়ও কাজ করেছেন সঞ্জীব চৌধুরী। দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে ফিচার বিভাগ চালু করার ক্ষেত্রে সঞ্জীব চৌধুরী বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নব্বইয়ের দশকের আগে সব সংবাদপত্র ভর্তি ছিল শুধু সংবাদ আর সংবাদে। ভোরের কাগজে কাজ করার সময় সঞ্জীব চৌধুরী প্রথমবার ফিচার লেখা শুরু করেন। তাঁর এই পদক্ষেপে সংবাদপত্রের কাটতি নাটকীয়ভাবে বেড়ে যেতে থাকে। ১৯৮৩ সালে একুশে বইমেলায় তিনি মৈনাক নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। ১৯৯৫ সালে সংগীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘দলছুট’ ব্যান্ড। গতানুগতিক ধারার বাইরে ব্যতিক্রমী কিছু গান নিয়ে কাজ করে অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যান্ডটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয় দলছুটের প্রথম অ্যালবাম ‘আহ’। এরপর ‘হৃদয়পুর’, ‘স্বপ্নবাজি’, ‘আকাশচুরি’, ‘জোছনা বিহার’, ‘টুকরো কথা’, ‘আয় আমন্ত্রণ’ নামে আরো কয়েকটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ‘স্বপ্নবাজি’ ছিল সঞ্জীব চৌধুরীর একক অ্যালবাম। ২০০৭ সালে প্রকাশিত ‘টুকরো কথা’ অ্যালবামটি সঞ্জীবের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্থে প্রকাশ পায়। এতে তাঁর লেখা কবিতাগুলোর সংকলন ছিল। এছাড়া ‘আয় আমন্ত্রণ’ হচ্ছে ব্যান্ডটির ষষ্ঠ ও সর্বশেষ অ্যালবাম। ২০১০ সালের ২৫ ডিসেম্বর সঞ্জীব চৌধুরীর ৪৭তম জন্মদিনে ‘সঞ্জী