প্যাট্রিক ওয়াডিংটন
অনুবাদ : নাজনীন সুলতানা নীতি
মার্ক জিরনডিন এতোদিন ধরে শহরের প্রকৌশল বিভাগের নথিপত্র শাখায় কাজ করছিলেন যে, এই শহরের প্রতিটি জায়গার অবস্থান, নাম, সড়ক বিভাজন থেকে শুরু করে সরু গলি, কানা গলি, সংকীর্ণ ঘুরতি পথের সবকিছু তার মন-মস্তিষ্কে একেবারে মানচিত্রের মতো আঁকা হয়ে গিয়েছিল। পুরো মন্ট্রিয়লে এতো জানাশোনার অধিকারী কেউ ছিল না; এমনকি একডজন পুলিশ এবং ট্যাক্সি ড্রাইভার মিলেও এই জায়গায় তাঁকে হারাতে পারতো না। তার মানে এই নয় যে, তিনি রাস্তাগুলোর নাম জাদুমন্ত্রের মতো বলে যেতে পারতেন। তবে অল্পবিস্তর যাতায়াত ছিল বলে রাস্তাগুলো স¤পর্কে বেশ ভালোভাবেই জানতেন তিনি। রাস্তাগুলোর অস্তিত্ব স¤পর্কে জানতেন, কোনটি কোথায় কোন অবস্থায় আছে সেটিও জানতেন। আর এটিই তাঁকে বিশেষজ্ঞ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। বলা চলে, নথিপত্র শাখার অবিসংবাদিত বিশেষজ্ঞে পরিণত হয়েছিলেন তিনি, যেখানে এ্যাশেট থেকে জোটিক পর্যন্ত সকল রাস্তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত বিবরণ তালিকাভুক্ত থাকত। অভিজাত, প্রকৌশলী, পানির লাইন পরিদর্শকের মতো ব্যক্তিসহ সবাই যে-কোনো বিশেষ বা বিস্তারিত তথ্যের প্রয়োজনে তাড়াহুড়ো করে তাঁর কাছেই আসত। যতই তারা তাঁকে অধস্তন কেরানী হিসেবে তুচ্ছজ্ঞান করত না কেন, তাঁকে সবারই প্রয়োজন হতো।
মার্ক ওভেন স্ট্রিটের (শেরব্রুক ইস্ট থেকে সেন্ট ক্যাথরিনে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে যা চলে গেছে) নিজের বাসা থেকে তাঁর অফিসকেই বেশি পছন্দ করতেন, যদিও সেখানে তাঁর কাজে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপক কিছু ছিল না, তবুও সেটি তাঁর পাশের ঘরের প্রতিবেশী আর বাড়িওয়ালার রোজকার চিৎকার-চেঁচামেচি আর শোরগোলের চেয়ে ভালো ছিল। একবার মার্ক তাঁর পাশের ভাড়াটিয়া লুইকে নিজের পদের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সুফল মেলেনি। লুই ঠিকই মুখ বাঁকিয়ে বিদ্রƒপ করেছে তাঁকে।
‘তো ক্রেগ যদি ব্লিউরিতে ঢোকে আর ব্লিউরি যদি পার্ক হয়, তাতে কি এসে যায়? এতে উত্তেজনার তো কিছু নেই।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি আপনাকে দেখাচ্ছি’, মার্ক বললেন। ‘আগে বলুন তো, আপনি কোথায় থাকেন?’
‘আপনি কি পাগল? এই ওভেন স্ট্রিটেই তো থাকি! আর কোথায়?’ লুইয়ের জবাব।
‘সেটা আপনি কীভাবে জানলেন?’
‘আমি কীভাবে জানি মানে কী? আমি তো এখানেই থাকি। ভাড়া দিই এখানে, আমার চিঠিপত্র এখানেই তো আসে, নাকি?’
মার্ক ধৈর্যের সঙ্গে মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘এর কোনোটিই তো প্রমাণ নয়। আপনি এখানে ওভেন স্ট্রিটে থাকেন, কারণ সেটাই আমার নথিপত্র শাখার সূত্র বলছে। আর পোস্ট অফিসও এই ঠিকানায় আপনাকে মেইল পাঠাচ্ছে, কারণ আমার কার্ড তালিকায় তাই আছে। কার্ডগুলো যদি এটি না বলে তাহলে আপনার অস্তিত্ব থাকবে না এবং এই ওভেন স্ট্রিটও থাকবে না। এটাই হচ্ছে আমলাতন্ত্রের জয়, বুঝলেন বন্ধু!’
লুই মহাবিরক্তি নিয়ে চলে যাওয়ার আগে বিড়বিড়িয়ে বললেন, ‘এসব কথা বাড়িওয়ালাকে বলে দেখুন।’
মার্ক তার অবিসংবাদিত কাজ অব্যাহত রেখেছিলেন। এর মধ্যে তাঁর চল্লিশতম জন্মদিন এলো এবং কোনো রকম লক্ষণীয় কিছু হওয়া ছাড়া চলেও গেল। দিনের পর দিন এভাবে ঘটনাবিহীনভাবে কাটল। এক রাস্তার নতুন নামকরণ হলো, আরেকটা তৈরি হলো, তৃতীয়টি প্রশস্ত করা হলো। আর এই সবকিছুই নথিপত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। তারপর এমন কিছু ঘটল যা মার্ককে শুধু বিস্মিতই নয়, হতবিহ্বল, স্তম্ভিত করে দিলো, বলা চলে, পুরো নথিপত্র শাখার জগৎটাকেই একরকম ভিত্তিমূল ধরে কাঁপিয়ে দিলো।
এক আগস্টের বিকেলে, একটি ড্রয়ার পুরোপুরি খুলতে গিয়ে কোথায় যেন আটকে গেল। ভালো করে দেখতে গিয়ে মার্ক দেখলেন, ড্রয়ারের একদম পেছনে ওপর আর নিচের মাঝে একটি কার্ড আটকে আছে। মার্ক সেটিকে টেনে বের করলেন। দেখা গেল, এটি একটি পুরনো ইনডেক্স কার্ড, নোংরা এবং ছেঁড়া, তবে এখনো এর সুস্পষ্ট পাঠোদ্ধার করা সম্ভব। এতে রু দ্য লা বুতেই ভেত বা গ্রিন বটল স্ট্রিটের লেবেল লাগানো ছিল।
মার্ক অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তিনি এতো অদ্ভুত নামের জায়গা তো দূরের কথা, এ-জাতীয় নামের কোনো কিছুই কখনো শোনেননি। নিঃসন্দেহে আধুনিক ধারা অনুসারে এর অন্য কোনো নামকরণ হয়েছে। তিনি কার্ডে তালিকাভুক্ত বিবরণগুলো ভালো করে দেখে রাস্তার নামের মূল ফাইলগুলোতে এলোমেলোভাবে খুঁজতে শুরু করলেন। কিন্তু এই নামটা সেখানে ছিল না। তিনি ক্যাবিনেটের মধ্যে যত্নসহকারে সময় নিয়ে আবারো খুঁজলেন। সত্যিই এ-নামের কিছু ছিল না, একেবারে কিছুই নয়! আরো একবার তিনি কার্ডটি পরীক্ষা করলেন। একেবারে নির্ভুল। জায়গাটিতে নিয়মিত রাস্তা পরিদর্শনের সর্বশেষ তারিখটি ঠিক পনেরো বছর, পাঁচ মাস, চৌদ্দ দিন আগের।