হাসান হাফিজুর রহমানের রাজনৈতিক চেতনার উদ্ভাস

সৌভিক রেজা

একজন কবির কাছ থেকে আমরা কী আশা করি? তাঁর কাছে একেকজন পাঠকের একেকরকম চাহিদা থাকে। তবে প্রাজ্ঞ পাঠকের প্রায় সবাই একজন কবির কাছে আশা করেন তাঁর মৌলিকতা, তাঁর কাব্যসৃষ্টির অভিনবত্ব। আজ থেকে অনেক বছর আগে, ১৮৮৬ সালে, কবি জেরাল্ড হপকিন্স (১৮৪৪-১৮৮৯) জানিয়েছিলেন,\

`Every true poet, I thought, must be original and originality a condition of poetic genius.’ যে কবি-প্রতিভার কথা হপকিন্স বলতে চেয়েছিলেন, হাসান হাফিজুর রহমানের কাব্যসমগ্রের মধ্যে তার একটি ধারাবাহিক প্রতিফলন দেখতে পাই।

মাত্র একান্ন বছরের পরমায়ু নিয়ে হাসান নিজেকে এক অবিশ^াস্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের আরেকজন খ্যাতিমান কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছিলেন, হাসান হলেন ‘একুশের সংকলনের সাহসী নির্মাতা, সাম্প্রতিক ঘটনার বিদগ্ধ ভাষ্যকার; প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলনের নিবেদিত সংগঠক, সমকাল-গোষ্ঠীর মধ্যমণি কিংবা স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের সত্যভাষী গবেষক।’ অন্যদিকে, ধীমান অধ্যাপক-গবেষক রফিকউল্লাহ খানের মূল্যায়ন হচ্ছে, ‘‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলন-সম্পাদনা বাঙালি জীবনের এক মহত্তম কীর্তি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ ও তার পরিণামের মধ্যে হাসান হাফিজুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের রক্তবীজ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনের পেছনে তাঁর শ্রম, ত্যাগ ও নিষ্ঠার যে স্বাক্ষর বিধৃত, সমকালীন ইতিহাসে তা তুলনারহিত।’ এরই সঙ্গে তিনি যোগ করেছিলেন, ‘ষোলো খণ্ডে সমাপ্ত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ : দলিলপত্র’ সম্পাদনা তাঁর জীবন ও কর্মের ধারাবাহিকতারই সাক্ষ্যবাহী। একুশে ফেব্রুয়ারি দিয়ে যার সূত্রপাত, মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে তার সমাপ্তি। জীবনাদর্শের সঙ্গে কর্মযোগের এই সমন্বয় তাঁকে একক অনন্যতায় উদ্ভাসিত করে।’ আর সেই উদ্ভাসিত অনন্য ধারাবাহিকতার নজির সামনে এনে রফিকউল্লাহ খান আরো বলেছিলেন, ‘কর্মী ও মানুষ হিসেবে একজন সাহিত্যস্রষ্টার যে দায়বদ্ধতা, হাসান হাফিজুর রহমানের জীবন ও কর্মের মধ্য দিয়ে তার আদর্শরূপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’

বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ  –  এই দীর্ঘ পথ-পরিক্রমার সার্বিক চেতনা সম্পর্কে হাসান নিজেও অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। আর সে-কারণেই তাঁর পক্ষে এইভাবে বলা সম্ভব হয়েছিল, ‘যে মৌলিক চেতনা ভাষার অধিকার রক্ষায় আমাদের জাগ্রত করেছে তা স্বাধীনতা সংগ্রামেরও প্রেরণা। সেজন্যে বলতে পারি, চারিত্রগত দিক থেকে ভাষা এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম এক জাতের মূল্যবোধের ফসল। দুটোই মৌলিক অধিকার রক্ষা বা আদায়ের সংকল্পে উদ্বুদ্ধ।’ হাসানের কবিতায় এবং তাঁর কাব্যচেতনায় সেই উদ্ভাসনের একটি সামগ্রিক চিত্র আমরা দেখতে পাই।

দুই

হাসান হাফিজুর রহমানের অপ্রকাশিত কবিতার ভূমিকা লিখতে গিয়ে কবি শামসুর রাহমান বলেছিলেন, ‘আমরা যারা ছিলাম হাসান হাফিজুর রহমানের কাছের মানুষ, আমরা যারা তাঁর প্রীতি ও সহৃদয়তার পরিচয় পেয়েছি, পেয়েছি সেই সংবেদনশীল শিল্পী মানুষটির বন্ধুতা, আমাদের অস্তিত্বের একটি অত্যন্ত প্রিয় অংশ বিলীন হয়ে গেছে তাঁর আকস্মিক অকাল মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে।’ সেইসঙ্গে শামসুর রাহমান তাঁদের বন্ধুত্বের পুরনো দিনগুলোকে সামনে এনে লিখেছিলেন, ‘মনে পড়ে আমাদের প্রথম সাক্ষাতের দিনে হাসানই … আমার কবিতা তাঁর ভালো লাগে, এ কথা … আমাকে জানিয়েছিলেন রোদ ঝলমলে সদরঘাটের মোড়ে দাঁড়িয়ে।’ সেইটা জানতে পেরে নিজের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে রাহমান বলেছেন, ‘হাসানের তারিফে আমি যুগপৎ বিস্মিত ও উল্লসিত হয়েছিলাম। একজন নতুন লেখকের পক্ষে এ-ধরনের প্রশংসা কতটা উৎসাহ  –  উদ্দীপক তা শুধু নতুন লেখকরাই জানেন।’ আবার, আমরা এ-ও দেখতে পাই  –  কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তাঁর একটি লেখায় হাসান হাফিজুর রহমানকে শুধুই কবি নন, সেইসঙ্গে একজন ‘কবি-নির্মাতা’ হিসেবে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন।

শুধু অন্যদের সাক্ষ্য নয়, হাসানের নিজের স্বীকারোক্তির মধ্যেও দেখতে পাই, এইসব বিষয় নানাভাবে উঠে এসেছে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘বন্ধুদের কোনো ভূমিকা আমার সাহিত্যচিন্তায় তেমন পড়েনি। সহকর্মী ছিলাম। পরস্পরকে সাহায্য করেছি। বই প্রকাশ করেছি। আমার প্রধান ভূমিকা ছিল সাংস্কৃতিক সংগঠকের।’ সেই বিবেচনা থেকেই, খুবই যথাযথভাবে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পর্কে, শামসুর রাহমান  বলেছিলেন, ‘সহজেই তিনি যে-কোনো মানুষকে আপনজন বলে গ্রহণ করতে পারতেন। এ জন্যেই তিনি ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে লোকপ্রিয়। তাঁর ব্যবহারে এমন এক সহজ, সুন্দর মাধুর্য ছিলো যে, যিনি তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন, তিনি তাঁকে ভালো না বেসে পারেননি।’ হাসান সম্পর্কে এরচেয়ে বড় সত্যি আর কিছুই হতে পারে না।

তিন

পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শামসুর রাহমান বলেছিলেন, ‘আমাদের আড্ডার প্রধান বিষয় ছিলো সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং রাজনীতি। … হাসান রাজনীতি সম্পর্কে কথা বলতে পছন্দ করতেন এবং তাঁর রাজনীতি  –  প্রীতি এবং তাঁর প্রগতিশীল চিন্তাধারাই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিলো “দাঙ্গার পাঁচটি গল্প” এবং “একুশে ফেব্রুয়ারী” নামক বিখ্যাত সংকলন দুটি প্রকাশ করতে।’ এসবের সঙ্গে কবি শামসুর রাহমান আরো বলেছিলেন, ‘দুটো সংকলনেরই অর্থ ও শ্রমের উৎস খোদ হাসান হাফিজুর রহমান, যিনি আমৃত্যু ছিলেন অসাধারণ উদ্যমী, নিষ্ঠাবান।’ অন্যদিকে, তাঁর নিজের রাজনৈতিক সচেতনতার ইতিহাস বিষয়ে হাসান জানিয়েছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের ছাত্র থাকাকালে, ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠনের সাথে আকস্মিকভাবে জড়িয়ে পড়ি। ফুটবল খেলতাম। … ওদের ছাত্রফ্রন্ট থেকে এ.জি.এস. পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি। নির্বাচনে জয়ী হই। … এরপর বন্ধু বাহাউদ্দিন চৌধুরী আমার কাছে একটি প্রশ্ন রেখেছিলেন  –  যা আমার জীবনের মোড় পাল্টে দেয় : ‘হাসান, শেষ পর্যন্ত তুমি মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে দাঁড়ালে?’

এখানেই ঘটনার শেষ নয়, এর রেশ হাসানের চেতনায় রয়ে যায় দীর্ঘদিন। হাসান বলেছিলেন, ‘তাঁর [বাহাউদ্দিন চৌধুরী] কাছ থেকেই কমিউনিজমের দীক্ষা আমি প্রথম পাই। সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে পাকিস্তানের অসারত্ব প্রমাণ করলেন তিনি। এতে আমি পুরোপুরি কনভিন্সড হয়ে গেলাম। বাহাউদ্দিনই প্রথম শ্রেণী-সংগ্রামের দীক্ষা দেন আমাকে।’ এর পরে যা  –  যা ঘটেছে, সে-সম্পর্কেও হাসান তাঁর পাঠকদের অকপটে জানিয়েছেন, ‘বি.এ. পড়ার সময় সব হলের নির্বাচনী ইস্তেহার আমিই লিখতাম। এ-সময়ই কমিউনিস্ট পার্টির সাথে জড়িত হই। সদস্য ছিলাম না। সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে কাজ করতাম।’ এরই সূত্র ধরে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ হয় ১৯৫০ সালে। কোনো রাজনৈতিক কাজ করিনি। সাংস্কৃতিক পর্যায়ে কাজ করতাম। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং-এ উপস্থিত ছিলাম। সেখানে জ্ঞান চক্রবর্তীর মতো ব্যক্তিও উপস্থিত ছিলেন।’

এ তো গেল সত্যের একদিক। এর আবার ভিন্ন  –  আরেকটি দিকও রয়েছে। হাসানই  সেটা বলেছেন, ‘কমিউনিস্ট পার্টির নীতির সাথে কোনওদিন আমার পুরোপুরি বনতো না। কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে তর্ক করেছি। ছাত্র ইউনিয়নের ভাগ হবার সময়ও আমি সেটা সমর্থন করতে পারিনি।’ একটা রাজনৈতিক সংগঠনের নীতি কিংবা মতাদর্শের সঙ্গে এই যে চিন্তার বনা  –  না  –  বনা, তার নেপথ্যের কারণগুলো পুরোপুরি বুঝে নিতে পাঠকদের তেমন  –  একটা অসুবিধা হয় না। হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন এমন একজন আত্মসচেতন কবি, যিনি আমৃত্যু আত্মজিজ্ঞাসাকে কখনো খারিজ করে দেননি।

এই আত্মজিজ্ঞাসা তাঁকে মতান্ধতার কবল থেকে নানাভাবে রক্ষা করেছে, যেটি কবি বিষ্ণু দে কিংবা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো রাজনীতিসচেতন কবিদের মধ্যে বিভিন্ন চেহারায় আমরা দেখতে পাই। শামসুর রাহমান অত্যন্ত যৌক্তিকভাবেই বলেছিলেন, ‘হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন বরাবরই একজন দায়বদ্ধ লেখক। … এই দায়বদ্ধতা কখনো তাঁকে ত্যাগ করে যায়নি, বরং বিষ্ণু দে-র পরাক্রান্ত দৃষ্টান্তে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি দায়বদ্ধতার মধ্যেই কবিতার মুক্তি খুঁজেছেন।’ শুধু কবিতারই মুক্তি নয়, এর মধ্যে দিয়ে হাসান হাফিজুর রহমান যেন আত্মচেতনার যে  –  মেধাবী  –  বেদনা, তার মুক্তি খুঁজে পাবারও একটা পথ পেয়ে গিয়েছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *